গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা ও শীল পালন
উপল বড়–য়া : এমন মানব জনম আর কি হবে / মন যা কর ত্বরায় কর এই ভবে…
প্রতিটি ধর্মগ্রন্থ- ধর্মপ্রচারকগণ বারে বারে একটি কথায় বলেছেন। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষের ভেতরেই বাস করেন ঈশ্বর। মানুষের ভেতরে ধ্বংসের বীজ; মানুষের ভেতরে সৃষ্টির বীজ। মানুষে মানুষে মিলেই তো পৃথিবীটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সুন্দরের দিকে। ২৫০০ বৎসর পূর্বে গৌতম বুদ্ধ বলেছেন- ‘মানুষ জন্মেই শ্রেষ্ঠ জন্ম।’ মানব জীবন পাওয়ার জন্য পার হতে হয় কত শত পারমী-উপপারমী। গৌতম বুদ্ধ নিজেও কর্মফলের প্রভাবে শত-শতবার তির্যককুলে জন্ম নিয়েছেন। বানর থেকে শুরু করে হস্তীরাজ কিংবা পাখি হয়ে জন্ম নিতে হয়েছিল তাঁর। গৌতম বুদ্ধের এই পূর্বজন্মের কাহিনী পাওয়া যায় জাতকগ্রন্থে। এই সময়টা মূলত ছিল তাঁর বোধিসত্ত্ব অবস্থা। মানুষ জন্ম লাভ করেই তিনি লাভ করেছেন আরাধ্য নির্বাণ। দিয়ে গেছেন বৌদ্ধ-দর্শন। দেখিতে দিয়ে গেছেন মানব মুক্তির পথ। নির্বাণ প্রাপ্তির পথ। পৃথিবীতে গৌতম বুদ্ধের পূর্বেও লক্ষাধিক কোটি পরিমাণ বুদ্ধ পৃথিবীতে এসেছেন। ভবিষ্যতেও পৃথিবীতে আবির্ভূত হবেন বুদ্ধগণ। মানব মুক্তির জন্য তৈরি করবেন নির্বাণের পথ। ‘অপ্পকা বালুকা গঙ্গা/অনন্ত নিব্বুতা জিনা। (গঙ্গায় যে পরিমাণ বালুরাশি, তার পরিমাণ বুদ্ধগণ পৃথিবীতে এসেছেন)।
দান-শীল-প্রজ্ঞা-মৈত্রী-সমাধি যার ভেতরে পরিপূর্ণতা লাভ করবে তিনিই পাবেন নির্বাণের দর্শন। গৌতম বুদ্ধ গৃহী-শ্রামণ-ভিক্ষুদের জন্য দিয়ে গেছেন কিছু নিয়মকানুন-শীল। শীল মানে চরিত্র। সংবিধানও বলা যায়। যারা গৃহী তাদের জন্য পঞ্চশীল। শ্রামণদের জন্য দশশীল। ভিক্ষুদের জন্য দুইশত সাতাশ শীল। বুদ্ধের এই শিক্ষা বা শীল প্রতিজন গৃহীর জন্য অনুকরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ।
১) প্রাণীহত্যা থেকে বিরত থাকার শিক্ষা
২) অদত্ত বস্তু বা চুরি থেকে বিরত থাকার শিক্ষা
৩) মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকার শিক্ষা
৪) কাম-ব্যাভিচার থেকে বিরত থাকার শিক্ষা
৫) সুরা বা মাদক দ্রব্য থেকে নিজেকে বিরত থাকার শিক্ষা
এই পঞ্চশীল একটি আরেকটির সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। হয়তো কেউ মাদক দ্রব্য গ্রহণ করে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে কাম-ব্যভিচার জাতীয় পাপাচারে লিপ্ত হলো। তখন তাকে এই পাপাচার ঢাকার জন্য মিথ্যা বলতে হচ্ছে। হয়তো স্বাক্ষী গোপন রাখতে কোন নিরপরাধ প্রাণকে হত্যা করতে হচ্ছে। ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি একটি শীলভঙ্গ বা পাপ কিভাবে আরেকটি পাপ বা অন্যায়ের দিকে নিয়ে যায়।
ব্দ্ধু বলেছেন- ‘মানব জীবন অত্যন্ত কঠিন।’ অনেক জন্মের পূণ্যের ফসল হচ্ছে এই মানবজীবন। সামান্য একটি ভুলের কারণে আপনাকে ভুগতে হতে পারে শত শত জনম (স্বয়ং বুদ্ধকেও গত জনমের পাপের কর্মফল ভুগতে হয়েছিল ব্দ্ধুাবস্থায়)। আবার এই মানব জীবনই অধরাকে পাওয়ার শ্রেষ্ঠ আকর।
আত্মাকে নিত্য স্বীকার না করা :
বৌদ্ধযুগে বেদ-বিশ্বাসী ব্রাহ্মণ ও পরিব্রাজকেরা মনে করতেন, আত্মা এক নিত্য ও চেতন শক্তি। অর্থাৎ আত্মা অমর, যার ক্ষয় নেই, যার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, যাকে অস্ত্র দ্বারা কাটা যায় না, আগুনে পোডানো যায় না। এই নিত্য চেতন শক্তি শরীর থেকে পৃথক। কোন দেহে চেতনা বা আত্মা থাকলে সে তখন জীবিত। দেহ থেকে চলে গেলে মৃত। এই সময় কিছু উন্নত চিন্তার এগিয়ে থাকা মানুষ জানালেন- আত্মা শরীরেরই গুণ, শরীর থেকে পৃথক কোন শক্তি নয়। শরীরে নির্দিষ্ট পরিমাণে ভূত-পদার্থের (মৌল পদার্থের) মিশ্রণের রাসায়নিক প্রক্রিয়ার ফলে শরীরে উষ্ণতা, উদ্যম ও চেতনা সৃষ্টি হয়। ভূত পদার্থের তারতম্য ঘটলে আবার তা হারিয়ে যায়। বুদ্ধ আত্মাকে ‘অনিত্য’ বললেন। তবে তাঁর এই ‘অনিত্য’ শব্দার্থ তাঁর সমসাময়িক চিন্তাবিদদের ‘অনিত্য’ শব্দার্থের চেয়ে কিছু আলাদা।
বুদ্ধ আত্মার সংজ্ঞা দিলেন- ‘চিত্ত-বিজ্ঞান’ বা ‘মনো-বিজ্ঞান’ আর ‘আত্মা’ একই বস্তু। আমরা যেভাবে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, ত্বক ও জিহ্বা এই পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে প্রত্যক্ষ করতে পারি, মনকে সেভাবে পারি না। চোখ হয়তো লোভনীয় খাদ্যবস্তু দেখতে পেল। নাক তার গন্ধ এনে দিল। জিহ্বা ইন্দ্রিয় ভোগ তৃষ্ণা অনুভব করল। জিভে জল চলে এল। এই যে চোখ, নাক ও জিভ এই তিন ইন্দ্রিয়কে মেলাবার ভূমিকা যে পালন করল সেও ইন্দ্রিয়। বিভিন্ন ইন্দ্রিয়কে চালনাকারী ইন্দ্রিয়র নাম ‘মন’। এই মন বা চিত্তই আত্মা, ( মনোবিজ্ঞান অবশ্য মনকে ইন্দ্রিয় বলে স্বীকার করে না।)
বুদ্ধের মতে- ‘সবকিছুই অনিত্য, ক্ষণস্থায়ী।’ বুদ্ধের এই সর্বব্যাপী পরিবর্তন, বিবর্তন, অনিত্য তত্বই ‘ক্ষণিকবাদ’ নামে পরিচিত। ক্ষণিকবাদ অনুসারে জগৎ নিয়ত পরিবর্তনশীল। যার শুরু আছে, তার শেষ আছে। যার জন্ম আছে, তার মৃত্যু আছে। জাগতিক বস্তু, প্রকৃতিক বস্তু ও মানসিক চিন্তা-ভাবনা সবই নিরন্তন পরিবর্তিত হচ্ছে। বুদ্ধের কথায় এই পরিবর্তনই একমাত্র সৎ, শাশ্বত, সনাতন।
যে প্রদীপ শিখাকে আমরা জ্বলন্ত দেখি, সেই শিখার কিছুক্ষণ আগে দেখা আগুন ও কিছুক্ষণ পরে দেখা আগুন এক নয়। প্রতিটি মুহূর্তে জ্বলছে নতুন আগুন। যতক্ষণ প্রদীপে তেল ও পলতে থাকবে ততক্ষণ আগুন জ্বলবে। প্রতিটি মুহূর্তের ভিন্ন ভিন্ন আগুনের শিখাকে প্রতিটি মুহূর্তে আমরা দেখছি এবং ভাবছি- একই আগুন।
আমাদের শরীর প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে। পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে আসা একটি মানুষের কথা ভাবুন। পাঁচ মাসের শিশু, পনেরোর কিশোর, পঁচিশের যুবক ও পঞ্চাশের প্রৌঢ়ের শরীর এক নয়। আমাদের শরিরের প্রতিটি অণু (বর্তমানে আমরা বলি দেহকোষ) প্রতিক্ষণে পরিবর্তিত হচ্ছে। পাঁচ মাসের শরীর ও পঞ্চাশ বছরের শরীর এক থাকে না। একই ভাবে একই মানুষের পাঁচ মাসের মন, পনেরোর কিশোর মন, পঁচিশের যুবক মন ও পঞ্চাশের প্রৌঢ় মন এক থাকে না। এই মনরূপ আত্মা সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়।
মনের বাইরে কোন আত্মা নেই। মন বা চিত্ত-বিজ্ঞান প্রতিটি মুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে। কোন কিছু আমাদের আনন্দ দেয়, আবার কোন ঘটনা আমাদের দুঃখ। কখনো আমরা ক্রুদ্ধ হই, আবার কখনো-বা ভীত। ফলে আমাদের মন বা আত্মাও পরিবর্তিত হচ্ছে।
প্রশ্ন আসতেই পারে- মন বা আত্মা যদি ক্ষণিক হয়, তবে আমাদের অভিজ্ঞতা স্মৃতিরূপে মনে থাকে কী করে? উত্তরে বুদ্ধের মত- বংশের ধারা অনুসারে মা-বাবার কিছু রূপ-গুণ-দোষ সন্তান বা পরবর্তী প্রজন্মে দেখা যায়। তেমনই আমার পনের বছরের মন তার অভিজ্ঞতাকে উত্তরাধিকার সূত্রে পঞ্চাশ বছরের মনকে দেয়; আর তারই ফল স্মৃতি। বুদ্ধ জানালেন, ‘আত্মা বা চিত্ত-বিজ্ঞান যেহেতু শরীরেরই গুণ, তাই শরীর বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে আত্মারও বিনাশ ঘটে।’ বৌদ্ধ দর্শন, রাহুল সাংকৃত্যায়ন