
জাতক
কামরুল আহসান : বৌদ্ধদের মতে জাতকগুলো গৌতম বুদ্ধের অতীত জন্মবৃত্তান্ত। কারণ এক জন্মের কর্মফলের দ্বারা কেউই সম্যক সমৃদ্ধ হতে পারেন না। তিনি বোধিসত্ত্ব অর্থাৎ বুদ্ধাষ্কুর-বেশে কোটিকল্পকাল নানা যোনিতে জন্ম -জন্মান্তর পরিগ্রহ করে সৎকর্মের দ্বারা চরিত্রের উৎকর্য সাধন করেন এবং পরিশেষে তিনি পূর্ণপ্রজ্ঞা লাভ করে বুদ্ধ হন। যিনি বুদ্ধ হন তিনি নিজের বা অন্যের অতীত জন্মবৃত্তান্তসমূহ দেখতে পান। গৌতম বুদ্ধও এই ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। তিনি শিষ্যদের উপদেশ দেওয়ার সময় অতীত কথাসমূহ শুনিয়ে তাঁদের নির্বাণপথের অভিমুখী করে তুলতেন। তিনি ‘মহাধম্মপাল জাতক” (৪৪৭) বলে পিতা শুদ্ধোদনকে বৌদ্ধর্ধমে দীক্ষিত করেন। ‘চন্দ্রকিন্নর জাতক’ (৪৭৫) বলে যশোধরাকে পাতিব্রত্যধর্ম সম্পর্কে বুঝিয়েছিলেন। আর ‘সম্পন্দন জাতক’, (৪৭৫) ‘ দদ্দভ জাতক’ (৩২২), ‘লটুকিক জাতক’, ‘ বৃক্ষধস্ম জাতক’ (৭৪) ও ‘সম্মোদমান জাতক’ (৩৩) এই পাঁচটি জাতক শাক্য ও কোলিয়দের মধ্যে বিরোধ মিটাবার কাজে বলেছিলেন। প্রত্যেক জাতকেই এরকম কোনো না কোনো প্রসঙ্গে কথিত হয়। এসব জাতক পরবর্তীকালে বুদ্ধের শিষ্যরা সংগ্রহ করেন।
‘জাতকার্থবর্ণনা’ নামক পালি গ্রন্থে জাতক সংখ্যা ৫৪৭। জাতকার্থবর্ণনা কেবল জাতক সংগ্রহ নয়, এতে নিদানকথাকারে অতীত বুদ্ধগণের, বিশেষত গৌতম বুদ্ধের জীবনবৃত্তান্ত, প্রত্যেক জাতকের উৎপত্তির ইতিবৃত্ত এবং গাথাসমূহের বিস্তারিত ব্যাখ্যা আছে। ‘জাতকার্থবর্ণনা’ পালি ভাষায় রচিত। পালির উৎপত্তি মগধসহ কলিঙ্গে হতে পারে। পালির শব্দহত, উচ্চারণগত ও ব্যাকরণগত সাদৃশ্য দেখে মনে হয় এই ভাষা ওড্র-বঙ্গ-কামরূপী ভাষার জননী। এমনকি পালিভাষা সিংহলেরও ভাষা ছিল বলে কোনো কোনো প-িত মনে করেন। জাতকের তিনটি অংশ বর্তমান কথা, মুল জাতক ও অতীতবস্তু।
অধ্যাপক হজসন বলেন, তিব্বতদেশে ৫৬৫টি জাতকের একটি বড় জাতকমালা আছে। দাক্ষিণাত্য- বৌদ্ধশাস্ত্র উদীচ্য-বৌদ্ধশাস্ত্র উদীচ্য-বৌদ্ধশাস্ত্র অপেক্ষা বহু প্রাচীন। দাক্ষিণাত্য শাস্ত্রে জাতকের সংখ্যা ৫৫০টি। জাতকার্থবর্ণনায় ৫৪৭টি জাতক পাওয়া যায়। দাক্ষিণাত্য বৌদ্ধরা বলেন খ্রিস্টের ২৪১ বছর আগে মহামতি অশোকের পূত্র স্থবির মহেন্দ্র যখন ধর্মপ্রচারে সিংহলে যান তখন তিনি পালি ভাষায় লেখা ধর্মশাস্ত্র ও তার অর্থকণা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছলেন । সিংহলী ভাষায় সেই অর্থকথাগুলো অনুদিত হয়। একসময কী কারণে পালিতে রচিত মূল বিনষ্ট হয়ে যায়। খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকে বুদ্ধঘোষ সিংহরে গিয়ে পালিভাষায় তা পুনরায় অনুবাদ করেনব। সেই অনুবাদও আবার নষ্ট হয়ে যায়। সিংহলবাসীরা বুদ্ধঘোষের অনুবাদকে অবলম্বন করে তা আবার সিংহলীতে অনুবাদ করেন।
সমস্ত জাতক গৌতমবুদ্ধ রচিত বা কথিত বরে মনে হয় না। আখ্যানগুলোর রচনশৈলীতে পার্থক্য, পুনরুক্তি দোষ এবং গাথাসমূহের ভাষাগত ও কাব্যগুণগত বিভেদ দেখে মনেস হয় জাতকগুলো ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি দ্বারা রচিত রূপান্তরিত হয়েছিল। কোনো কোনো আখ্যায়িকায় বৌদ্ধভাব কৃত্রিম বলে মনে হয়। জাতকে ব্রহ্মদত্ত-এর ভণিতা আছে। আরব্য রজনীতে আছে খলিফা হারুণ অর রশিদের নাম। বেতাল পঞ্চবিংশতিতেে আছে বিক্রমাদিত্যের কথা। গৌতম বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর সপ্তপর্ণী গুহায় যে প্রথম সঙ্গীতে হয় ত্রিপিটক তাতে সষ্কলিত হয়। কারো কারো মতে বুদ্ধের পরিনির্বাণের একশ বছর পর বৈশালীতে যে সঙ্গীতি হয় তাতে ত্রিপিটক সষ্কলিত হয়েছির। আর এর তুলনায় বৃহৎকথা, পঞ্চতন্ত্র, কথাসরিৎসাগর একেবােের অর্বাচীন বচা সেদিনের গ্রন্থ মাত্র। বর্মা, শ্যাম, তিব্বত, চীন, জাপানে বহু প্রাচীনকালে জাতক চরে যায় এবং অনুদিত হয়্ ভারতে একসময় জাতক লোকমূখে প্রচলিত ছিল সিংহলে এখনো শিশু ও বৃদ্ধরা দিনের শেষে জাতকের কাহিনী শোনে। ক্রমে ভারতে বৌদ্ধপ্রভাব কমে গেলে জাতহকগুলোর বৌদ্ধভাব লুপ্ত হয় এবং অনেক জাতক নতুন আকারে হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়। রামায়ণ ও মহাভারতে জাতকের কাহিনী দেখা যায়। বৃহৎকথায় জাতকের কাহিনী পাওয়া যায়। জাতকের ‘দশরথ জাতক’ (৪৬১) একটি ছোটখাটো রামায়ণ। কে বলবে যে এর থেকে রামায়ণ রচিত হয় নি?
ঈশপের গল্পের অনেকগলোই জাতকের রূপান্তর। ঈশপে কিছু কিছু পাখি-পশু আছে যা ইউরোপে নেই। গ্রিক দার্শনিক পিথাগোরাস খ্রিষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতে এসে দর্শন ও জ্যামিতি শিখেছিলেন বচলে অনুমান করা হয্ পারস্যরাজ দারাযুস পাঞ্চাবের কিছু অংশ দখল করেছিলেন। তাঁর পুত্র জারক্সেম গ্রিস জয় করতে গিয়েছিলেন। এই যুদ্ধজয়ে ভারতের সঙ্গে পারস্য ও গ্রিসের পরিচয় ঘটেছিল। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে আলেকজা-ার ভারতবর্ষ জয় করেন। গ্রিকদের সর্বপ্রাচীন কথা সংগ্রহ আলেকজান্ডারের মুত্যুর পর খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অন্দে সম্পাদিত হয়। আলেকজান্দ্রিয়া নগরের বিখ্যাত পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা ডেমিট্রিয়াস ফেলিরিয়ুস এটি সংগ্রহ করেন। এতে দু’ শ’ কথাসঙগ্রহ সষ্কলিত হয় এবং এগুলোকে ‘ঈশপের কথা’ নাম দিয়ে প্রচার করা হয়।
খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে ফিড্রাস এগুলো লাতিন ভাষায় অনুবাদ করেন। এই ফিড্রাসের অনুবাদই এখন ঈশপের গল্প নামে প্রচলিত। এদিকে বাণিজ্য উপলক্ষে ভারতের সঙ্গে মিশরের সম্পর্ক স্থাপিত হরে লোকের মেলামেশা ও আদান-প্রদান বাড়ে। প্রাচীন মিশরি, গ্রিক ও রোমানরা ভারতের কাহিনী নিয়ে যায় নিজেদের দেশে। এভাবে অনেক জাতক ও অন্যান্য কথা ইউরোপে চলে যায়।
ভারতের ছবি আঁকার রীতিও ঐসব দেশে চরে যায়। বেরুটস্তূপে বৌদ্ধ কাহিনী চিত্রিত আছে। মধ্যপ্রাচ্যেও বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটে। ইহুদিরাও বৌদ্ধ জাতকের সঙ্গে পরিচিত হয। বাইবেলের সলোমান রাজার একটি বিচার মহ্য-উন্মাগৃ জাতকের (৫৪৬) অনুরূপ। এই কাহিনী খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে ইতালি পর্যন্ত চলে যায়। সম্পাই নগরীর ধ্বংসাবশেসের মধ্যে এর একটি চিত্র পাওয়া যায়। এছাড়াও ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থে জাতকের আরো কাহিনী আছে।
ঈশানচন্দ্র ঘোষ জাতকের প্রথম খন্ডে লিখেছেন খ্রিস্টীয় ধর্মশাস্ত্রে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব আছে। অষ্টম শতাব্দীর দামেস্্ক্¦াসী জন নামক সাধুপুরুষের গ্রিক ভাষায় রচিত ‘বার্লাম ও যোয়াসফ্্” একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ। ইউরোপের খ্রিস্টান সমাজেও যোসাফ্্ট্এক ‘যোসাফ্্’ নামে সাধুশ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে। এই যোসাফট যে ভারতবর্ষীয় রাজপূত্র তা গ্রন্থকার বলেছেন। ইউরোপীয় প-িতরা দেখিয়েছেন তিনি বোধিসত্ত্ব। আরবি ভাষায় বোধিসত্ত্ব ‘যোদাসফ্্’ এবং আরব থেকে গ্রীসে পৌঁছে হয় ‘যোসাফ্্ট্্’। এই জীবনী পড়লে গৌতম বুদ্ধকে সহজে মনে পড়ে।
‘মিত্রবিন্দক জাতক’ (১০৪) থেকে রচিত হয়েছে অডিসিয়ুসের শ্রমণবৃত্তান্ত। এছাড়া মিত্রবিন্দকের সঙ্গে সিন্দাবাদের ও সম্পর্ক আছে। ‘রাধা জাতক’ (১৪৫) আরব্য রজনীর কাহিনীতে স্থান পেয়েছে। ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের আগে মধ্যপ্রাচ্যে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ছিল, বৌদ্ধরাই শেষে মুসলমান হয়। কাজেই এখানকার অনেক কাহিনীতে জাতক কাহিনীর পরিচয় পাওয়া যাবে। আরবদের সংস্পর্শে এসে নিগ্রোরা জাতকের কাহিনী শেখে। দক্ষিণ কারোলিনার নিগ্রোদের রিমান্্ কাকার কাহিনী ‘শ্লেষরোম জাতক’্ ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড বিদ্রোহী ভূসআবামীদের ভর্ৎসনা করে ‘সত্যৎকিল জাতকে’র (৭৩) আখ্যায়িকা বলেছিলেন। চসার ‘বেদদ্ভ জাতক’ (৪৮) অবলম্বন করে ‘পারডোনার্স টেল’ রচনা করেন। শেক্্সপীয়রের মার্চেন্ট অব ভেনিদে আধা সের মাংস ও তিন পেটিকার কাহিনীতে জাতকের গল্প লুকয়ে আছে। গ্রীম ভাইদের কথাকোষে ‘দধিবাহন জাতক’ (দধিবাহন জাতক’ (১৮৬) প্রভূতি সতেরো আঠারটি জাতকের গল্প আছে।
