গণহত্যা কি বিজয় রুখতে পেরেছিল?
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা কার্যক্রম অপারেশন সার্চলাইটের অধীনে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে পরিচালিত হয়েছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে নির্মূল করতে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এ কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘ নয় মাসের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহায়তাকারী দলগুলো ৩০ লক্ষ ব্যক্তিকে হত্যা করেছিল। এছাড়াও ২ লক্ষ থেকে ৪ লক্ষ বাঙালি মহিলাকে পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণ করে। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সংঘটিত ঘটনাসমূহ গণহত্যা হিসেবে পরিচিতি পায়। অন্যদিকে ভারতীয় বংশোদ্ভূত জনৈকা মার্কিন শিক্ষাবিদ শর্মিলা বসু মন্তব্য করেছিলেন যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদীরাও যুদ্ধকালীন বিহারিদের উপর গণহত্যা কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন।
পশ্চিম পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ পূর্বাংশের বাঙালি মুসলিমদেরকে অতিমাত্রায় বাঙ্গালি হিসেবে ভাবতে শুরু করে। এ ধারণা দূর করতে পশ্চিমারা বাঙালিদেরকে জোরপূর্বক সাংস্কৃতিক ভাবনা থেকে দূরে রাখার কৌশল প্রবর্তন করে। পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকই বাঙালি ছিল। পূর্ব-পাকিস্তানে তাদের সংখ্যা ছিল ৭৫ মিলিয়ন ও পশ্চিম পাকিস্তানে পাঞ্জাবীভাষীদের সংখ্যা ৫৫ মিলিয়ন। পূর্বাংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকই মুসলিমসহ সংখ্যালঘিষ্ঠ বৃহৎসংখ্যক হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বসবাস। পশ্চিমারা তাদেরকে দ্বিতীয়-শ্রেণির নাগরিক হিসেবে মনে করত। ১৯৭১ সালে পূর্ব-পাকিস্তানে কর্মরত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রধান আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী এ অঞ্চলকে নিচু ভূমি, নিচু ব্যক্তিদের আবাসস্থলরূপে আখ্যায়িত করেছিলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের অল্প কিছুদিন পর ১৯৪৮ সালে গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নবগঠিত রাষ্ট্রের জাতীয় ভাষারূপে ঊর্দুকে ঘোষণা দেন। কিন্তু, ঐ সময়ে পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর কেবলমাত্র চার শতাংশ ঊর্দু ভাষায় কথা বলতেন। ১৯৫২ সালে পূর্ব-পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় বিক্ষোভ হয়। এ বিক্ষোভকে জোরপূর্বক দমন করা হয় ও বিক্ষোভকারীদের অনেকে নিহত হন। এ কারণে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদে উজ্জ্বীবিত ব্যক্তিরা তাদেরকে শহীদরূপে আখ্যায়িত করেন। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের বড় শহরগুলোতে গণহত্যা শুরু করে। তাদের পূর্বপরিকল্পিত এই গণহত্যাটি ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিচিত। এ গণহত্যার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আগে থেকেই পাকিস্তান আর্মিতে কর্মরত সকল বাঙালি অফিসারদের হত্যা কিংবা গ্রেফতার করার চেষ্টা করা হয়। ঢাকার পিলখানায়, ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের ই বি আর সিসহ সারাদেশের সামরিক আধাসামরিক সৈন্যদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকা-ের কথা যেন বহির্বিশ্বে না জানতে পারে সে জন্য আগেই সকল বিদেশি সাংবাদিকদের গতিবিধির উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয় এবং অনেককে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়। তবে ওয়াশিংটন পোস্টের বিখ্যাত সাংবাদিক সাইমন ড্রিং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের রিপোর্ট প্রকাশ করেন। এর মধ্য দিয়ে বিশ্ব এই গণহত্যা সম্পর্কে অবগত হয়। আলোচনার নামে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কালক্ষেপণও এই গণহত্যা পরিকল্পনারই অংশ ছিল। ২৫ মার্চ রাত প্রায় সাড়ে এগারোটার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এই ঘোষণায় তিনি পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্য বাংলার জনগণকে আহ্বান জানান। চট্টগ্রামে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে প্রচারের জন্য পাঠানো হয়। ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু ঘোষণাকে অবলম্বন করে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা এম. এ হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। ২৭ মার্চ অপরাহ্নে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ৮ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার আরেকটি ঘোষণা পাঠ করেন। এই ঘোষণাটিতে তিনি উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশে শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে।
পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক এই গণহত্যা ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকা-ের অন্যতম। প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন (৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য) অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করার ঘোষণায় পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণঅসন্তোষ সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় এবং পাকিস্তান সরকার প্রদেশে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি সৈন্যরা সেনানিবাসে অতর্কিতভাবে বাঙালি সেনা সদস্যদের ওপর হামলা চালায়। তারা পিলখানাস্থ পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) সদর দফতর, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক, খিলগাঁয়ের আনসার সদর দফতরেও সশস্ত্র হামলা চালায়। তাদের হাতে বন্দি হয় ৮০০ ইপিআর অফিসার ও জওয়ান। এদের অনেককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কিছুসংখ্যক ইপিআর সদস্য রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যান এবং পরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। পাকিস্তানি বাহিনী ট্যাঙ্ক দিয়ে ঢাকা শহর ঘিরে রাখে। আন্দোলনরত জনতাকে প্রতিরোধের জন্য তারা রাস্তায় রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা গড়তে তোলে এবং মেশিনগানের গুলিতে বাড়িঘর বিধ্বস্ত করে। তারা মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বাসভবন ও ছাত্রদের আবাসিক হলগুলোতে হামলা চালায়। এতে কয়েক শত ছাত্র ও অনেক শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিহত হন।
১৯৭১ সালের জুলাই মাস থেকে ছবিসহ বিদেশি সংবাদপত্র বাংলাদেশের গণহত্যার প্রতিবেদন প্রকাশ করতে শুরু করে। কতিপয় সদস্য-দেশ ছাড়া জাতিসংঘ এবং এর অপরাপর সদস্য-দেশ বাংলাদেশের ব্যাপারে সচেতন হয় এবং পাকিস্তানের বর্বরোচিত গণহত্যার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়। পাকিস্তানি নৃশংসতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত ক্রমান্বয়ে জাগ্রত হতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের জন্য পাকিস্তান সরকার তার দখলদার বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় রাজাকার, আল-বদর এবং আল-শামস বাহিনী গড়ে তোলে। তাদের গণহত্যা ক্যাম্পে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন করা হয়, ব্যায়নেট দ্বারা খুঁচিয়ে তাদের দেহ ক্ষতবিক্ষত করে শেষ পর্যন্ত গুলি করে হত্যা করে। অবশেষে গণহত্যার নির্মমতা ও বর্বরতাকে ম্লান করে দিয়ে লাল সবুজের মানচিত্র খচিত এক সমুজ্জ্বল পতাকা নিয়ে পৃথিবীর বুকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
লেখক : উপ-মহাপরিচালক, আনসার ও ভিডিপি একাডেমি (পিআরএল), সফিপুর, গাজীপুর
সম্পাদনা : আশিক রহমান ও মোহাম্মদ আবদুল অদুদ