বঙ্গবন্ধুর ডাকে জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী
ড. অনুপম সেন
চট্রগ্রামের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবন প্রায় ৫০ বছর ব্যাপি। তার রাজনৈতিক জীবনের কথা বলে শেষ করা যাবে না। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান যখন পূর্বপাকিস্তানের একটি উপনিবেশ হিসেবে শোষণ করত। আবার এই পূর্ব পাকিস্তানকে লুণ্ঠণের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য যে পুঁজি তারা সঞ্চয় করেছিল, সেই শোষণের বিরুদ্ধে ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙ্গালি জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা আন্দোলনের ডাক দিলেন। বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে একটি সভায় ৬ দফা আন্দোলনের কথাটি উত্থাপন করেন। পশ্চিম পাকিস্তানে ৬ দফার কথা উত্থাপনের ফলে, পূর্ব পাকিস্তানের অনেকেই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এমন কি আওয়ামী লীগের অনেক নেতাও ভয় পেয়েছিল। কারণ, ৬ দফার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু দুটি রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান করেছিলেন। তখন যারা ৬ দফা করেছিলেন, তারা জানেন বঙ্গবন্ধু দুটি মুদ্রা বা দুটি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পৃথক করেছিলেন। কেন্দ্রীয় শাসন সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন সামান্য কয়েকটি ক্ষেত্রে। আইয়ুব খান তখন বলেছিলেন, শেখ মুজিব যদি যুক্তির ভাষা না বুঝে, অস্ত্রের ভাষায় বুঝানো হবে। সেই সময় আওয়ামী লীগের মূখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানও ৬ দফাকে সমর্থন করেন নি। তাই বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে এক বিরাট সভার মাধ্যমে ৬ দফা আন্দোলনের কথা উত্থাপন করেন। সেই সময় বঙ্গবন্ধুকে যে সঙ্গ দিয়েছে, যারা তার কাছে ছিলেন, তাদের একজন হচ্ছেন তৎকালীন ছাত্র নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। সেই ১৯৬৬ সাল থেকে মহিউদ্দিন চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর কথায় জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিলেন। ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। তাকে জেলে নেওয়ার পরে তিনি পাগলের অভিনয় করে সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। আবার তিনি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ত্রিপুরায় বিএসএল-এর নেতা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। তিনি বার বার নিজের জীবনকে বিপন্ন করেছেন। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরে যারা বিদ্্েরাহ করে ছিলেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন, মৌলভী সৈয়দ ও মহিউদ্দিন চৌধুরী। ১৯৭৫ সালে বিদ্রোহ করে তারা ভারতে চলে যান। ভারত থেকে ফিরে মৌলভী সৈয়দসহ অন্যরা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আদর্শকে উজ্জীবিত রাখার চেষ্টা করেছিলেন। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ঘোষণা দিয়েছিল। তখন মৌলবী সৈয়দ সভাপতি ও মহিউদ্দন চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক। তখন মৌলবী সৈয়দকে হত্যা করা হয়। তারপর বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশে ফিরে আসেন। শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পরে যতগুলো আন্দোলন হয়েছিল, সেখানে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনার বিশ্বস্থ কর্মী ছিলেন। তিনি একজন বড় নেতাতে পরিনত হয়েছিলেন। ১৯৯৮ সালে চট্টগ্রামে যে ঝড় হয় সে ঝড়ে প্রচুর লোক মারা যায়। সেই সময় মহিউদ্দিন চৌধুরী কয়েক হাজার লোককে চট্টগ্রাম মুসলিম হলে স্থান দিয়ে তাদের চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করেন। ১৯৯৪ সালে যখন বিএনপি ক্ষমতায় তখন মহিউদ্দিন চৌধুরী তার জনপ্রিয়তা দিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। যেহেতু বিএনপি ক্ষমতায় তিনি তেমন সরকারী অনুদান পেতেন না। কিন্তু তিনি তার সাধ্যমতো চট্টগ্রাম বাসীকে সেবা দিয়েছেন। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে একটি নতুন রূপ দিয়েছিলেন। একই সাথে তিনি সরকার বিরোধী আন্দোলন করেন। আন্দোলন করার কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তখন পুরো চট্টগ্রামে তার মুক্তির জন্য বিক্ষোভ করেছিলেন। এমন বিক্ষোভ করেছিলেন, পুরো চট্টগ্রাম অচল হয়ে গিয়েছিল। তখন সরকার মহিউদ্দিনকে ছাড়তে বাধ্য হয়। এই নিয়ে সারা বাংলাদেশে একটি আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সবার মুখে একটি কথাই ছিলো, একজন মেয়র কিভাবে এতো জনপ্রিয় হয়। কারণটি ছিল, তার আসন ছিল জনতার হৃদয়ে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামের জন্য উন্নয়নমূলক কাজ করতে শুরু করেন। তিনি অল্প দিনে চট্টগ্রামকে সাজিয়ে তুলেন। সেই সময় একটি মার্কিন এসএস কোম্পানি চট্টগ্রাম বন্দরের মুখে তাদের স্থাপনা করতে চেয়েছিল। কিন্তু মহিউদ্দিন চৌধুরী সেটা করতে দেন নি। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন নিয়ে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। মার্কিন রাষ্ট্র থেকে, আওয়ামী লীগ থেকে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করে। আওয়ামী লীগ সরকার চায়নি এসএস কোম্পানিটি হোক। তাই মহিউদ্দিন চৌধুরীকে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে বলে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন মহিউদ্দিন চৌধুরী এর বিরুদ্ধে আন্দোলনের পাশাপাশি মামলাও করেন। তার হয়ে মামলা করেছিলেন ইঞ্জিনিয়ার মাহমুদুল ইসলাম। তিনি মামলাটিতে জিতেও যান। ফলে এসএস কোম্পানিটি তারা করতে পারেনি। এরপর যখন একটি থাই কোম্পানি চট্টগ্রাম বিমান বন্দরের একটি কাজ করতে চেয়ে ছিল, তখন আবার তিনি এর বিরুদ্ধে দাঁড়ান। কিন্তু তখন এই দেশের বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। তার সমর্থন থাই কোম্পানির পক্ষে ছিল। কারণ, এটি লাভবান মনে হয়েছিল। কিন্তু মহিউদ্দনর চৌধুরীর কারণে সেটা আর থাই কোম্পানিকে দেওয়া হয়নি। পরে মোশাররফ সাহেব প্রকাশ্য সভায় মহিউদ্দিনকে ধন্যবাদ জানিয়ে ছিলেন। তিনি বলেছিলন, মহিউদ্দিন সাহেব যথার্থ যৌক্তিক কাজ করেছিলেন। তাছাড়া তিনি চট্টগ্রামের শিক্ষার জন্য, নারী উন্নয়নের জন্য, চট্ট্রগ্রাম বস্তীবাসীর জন্য অনেক কাজ করেছেন। তিনি বস্তীবাসীর চিকিৎসা সেবার জন্য একটি ভালো কাজ করেছিলেন। বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলাদের জন্য। তিনি চট্টগ্রামে ৪৩ টি নতুন স্কুল এবং কলেজ করেছিলেন। যেটা আর কোনো শহরে নেই। তিনি কম্পিউটার ইস্টিটিউট, টেকনিক্যাল ইস্টিটিউট সহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান করেছেন। আমরা যে আজ ১৬ ডিসেম্বর পালন করি, সেই বিজয় দিবসের বিজয় মেলাটি তিনি চট্টগ্রামে প্রথম শুরু করেন। তার থেকে সারা দেশে এই বিজয় মেলাটি ছড়িয়ে পড়ে। যখনই জনগণের অধিকারের কথা এসেছে, মহিউদ্দিন চৌধুরী কারও সাথে কোনো আপোষ করেন নি। তিনি সবসময় জনগণের কাতারে ছিলেন। সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে অনেক পছন্দ করতেন। তিনি মারা যাবার পরে শেখ হাসিনা কান্নায় ভেঙ্গে পরেন। তাই সব দিক বিবেচনা করে বলা যায় , সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী নিঃসন্দেহে একজন ভালো মানুষ এবং মহান নেতা ছিলেন।
পরিচিতি : উপদেষ্টামন্ডলীরর সদস্য, আওয়ামী লীগ
মতামত গ্রহণ : গাজী খায়রুল আলম
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ