প্রশ্নপত্র ফাঁস জাতিকে মেধাশূন্য করার হাতিয়ার : সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
মারুফ হাসান নাসিম : প্রশ্নপত্র ফাঁস শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করার এক বিধ্বংসী পন্থা। ক্লাস টু এর প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে, কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা? জাতিকে মেধাশূন্য করার আরেকটা হাতিয়ার। শিক্ষাব্যবস্থার অনিয়মগুলো দিন দিন মহামারি আকার ধারণ করছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে গ্রেফতার হয়, জেল হয়, জরিমানা হয়, এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এসব করে প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করা যাবে না। দৈনিক আমাদের অর্থনীতির সাথে আলাপকালে শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এই সব কথা বলেন। তিনি বলেন, এখন গ্রামের শিক্ষকরা পর্যন্ত নেমে পরেছে কীভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা যায়, গ্রামের অভিভাবকরা নেমে পড়েছে কীভাবে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র পাওয়া যায়। বাজার কীভাবে সৃষ্টি হয়? যখন একটা চাহিদা থাকে এবং এর সরবারহ থাকে তখনই তো বাজার হয়ে যায়। ভালো বাজার দিতে না পারলে কালো বাজার হয়ে যায়। এখন কালো বাজার হোক আর সাদা বাজারই হোক সূত্র একটাই। বাজার তখনই হয় যখন চাহিদা থাকে এবং এর সরবারহ থাকে। চাহিদা বাড়বে, যোগানও বাড়বে। এখন আমরা চাহিদা সৃষ্টি করেছি এই কোচিং বাণিজ্যের নোটবই, গাইড বইয়ের মাধ্যমে।
তিনি আরও বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস যদি বন্ধ করতেই হয়, তাহলে আমাদের জরুরি কিছু কাজ করতে হবে। প্রথমে এই যে সরকার গ্রেফতার করছে, এটা তো ঠিক না। প্রশ্ন কেন ফাঁস হচ্ছে সেটা নিয়ে কিছইু করা হচ্ছে না। ব্যাপারটা এমন হচ্ছে, মাথা ব্যথা হয়েছে, তাই মাথাটাই কেটে ফেলছে। কিন্তু এই সব জিনিসের মাথা তো আর একটা থাকে না, অনেকগুলো থাকে। দুর্নীতির একটা মাথা কাটলে দশটা মাথা বের হয়। দুর্নীতির মাথা এত সহজেই কাটা যায় না। দুর্নীতির মূলটাকে ধরতে হবে। এই যে গ্রেফতার হচ্ছে কিন্তু সরকার আসল পালের গোদাদের ধরতে পরছে না।
আমরা একজনের নাম জানছি, দুজনের নাম জানছি, তারা কি শাস্তি পাচ্ছে? সেটা কি আমরা ফলোআপ করতে পারি না? কিছুদিন পর তো তারা জামিন নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। তখন কেউ ফলোআপ করে না, সরকার ফলোআপ করে না, মিডিয়াও ফলোআপ করে না। যারা তাদের দিয়ে কাজ করাচ্ছে, যাদের পকেটে আসল টাকাটা যাচ্ছে, যারা আসল ব্যবসায়ী তারা একটাও ধরা পড়ছে না। আর আমি জানি, পুলিশ কখনোই তাদের ধরতে পারবে না, কারণ তাদের হাতে কোটি কোটি টাকা। আর একটি কসমেটিক অপারেশন হবে, এই কসমেটিক অপারেশনে মানুষের চোখে কিছুদিন মলম মেখে তারপর কিছুদিন পর জামিন দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। নেহাৎ খুব হতভাগা হলে, কিছু লোকের চাকরি চলে যাবেÑ এই আর কি। মূল যারা তাদের কোন শাস্তি হয় না। আর ছেড়ে দেওয়ার পর তারা অন্য নাম দিয়ে এই ব্যবসা চালিয়ে যাবেই।
এই শিক্ষাবিদ আরও বলেন, শিক্ষার্থীরা পরিবারকে চাপ দিচ্ছে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র কিনে দিতে। তখন পরিবার নিরূপায় হয়ে টাকা দিয়ে প্রশ্ন কিনে সন্তানকে দিচ্ছে। আমরা পরিবারগুলোকে একেবারে দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলছি। সন্তানদের একদম বিপর্যস্ত করে ফেলছি। শিক্ষাব্যবস্থার অনিয়মগুলো দিন দিন মহামারি আকার ধারণ করছে। পাশ করার সব ধরনের ব্যবস্থা করেই এই পরীক্ষাগুলো নেয়া হয়। তাহলে প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে না তো কী হবে? রোগ যখন ছড়িয়ে পড়ে, মহামারি দেখা দেয়, তখন এটা থেকে কেউই রক্ষা পায় না। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১৩ তে কোচিং বাণিজ্য, নকল, প্রশ্নপত্র ফাঁস শাস্তি যোগ্য অপরাধ।
কীভাবে এই প্রশ্নপত্র ফাঁস থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারকে শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়াতে হবে। তাই আমাদের উচিত এই ক্ষেত্রে বাজেট এর ২৫ শতাংশ অথবা জিডিপির ৬ শতাংশ আমরা শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করতে। এছাড়া আমি মনে করি, আমাদের কাছে আর কোনো বিকল্প নেই। এতে শিক্ষকদের বেতন বাড়বে। জীবনযাত্রা যখন মানসম্পন্ন হবে, তখন অভাবের কারণে শিক্ষকরা এসব প্রশ্নপত্র ফাঁস ও নকলের মতো অপরাধের সাথে জড়িত হবে না। তখন মানসম্পন্ন শিক্ষাও পাওয়া যাবে, শিক্ষকও পাওয়া যাবে।