বাংলাদেশের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বড়দিন উৎসব
এলড্রিক বিশ্বাস
বড়দিন বা খ্রিস্টমাস উৎসব খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের জন্য একটি আনন্দের দিন। প্রতি বৎসর ২৫ ডিসেম্বর এ দিনটি বিশেষ তাৎপর্যের সঙ্গে পালন করা হয়। বড়দিন হিসেবে দিনটি বড় নয় কিন্তু মানব জাতির মুক্তিদাতা প্রভু যীশু খ্রিস্টের জন্মদিবস হিসেবে ফি বছর দিনটি একটি মহৎ দিন হিসেবে সবার কাছে পরিচিত।
দু’হাজার ১৬ বছর আগে এক অনাড়ম্বর পরিবেশে মুক্তিদাতা প্রভু যীশু খ্রিস্ট ২৫ ডিসেম্বর কনকনে শীতের রাতে বেথলেহেমের এক গোয়াল ঘরে জন্মেছিলেন। তাঁর জন্মের আগমনী বার্তা ভাববাদীর দ্বারা প্রচারিত হয়েছিল যা পবিত্র বাইবেলে উল্লেখ আছে।
ভাববাদীর বাণী : ভাববাদী যোহন প্রভু যীশু খ্রিস্টের আগমনী বাণী প্রচার করেন। যেমন যিশাইয় ভাববাদী বাক্য গ্রন্থে লিখিত আছে, ‘প্রান্তরে একজনের রব সে ঘোষণা করিতেছে, তোমরা প্রভুর পথ প্রস্তুত কর, তাঁহার রাজপথ সকল সরল কর।’ (পবিত্র বাইবেল-লূক; ৩ অধ্যায় ৪ পদ) যীশু যোহন দ্বারা বাপ্তাইজিত হইবার জন্য গালীল হইতে যর্দ্দনে আসিলেন। বাপ্তাইজিত অর্থাৎ দীক্ষ্মাস্নান নেওয়া। তখন জর্ডন নদীর তীরে অনেকে এসে দীক্ষ্মাস্নান নিত। ‘পরে যীশু বাপ্তাইজিত হইয়া অমনি জল হইতে উঠিলেন; আর দেখ তাঁহার নিমিত্ত স্বর্গ (আকাশ) খুলিয়া গেল এবং ঈশ্বরের আত্মাকে কপোতের ন্যায় নামিয়া আপনার উপরে আসিতে দেখিলেন। আর দেখ স্বর্গ হইতে এই বাণী হইল ‘ইহাই আমার প্রিয় পুত্র, ইহাতে আমি প্রীত।’ (পবিত্র বাইবেল-মথি; ৩ অধ্যায় ১৬-১৭ পদ)।
যীশুর জন্ম বিষয়ে বাইবেলীয় ব্যাখ্যা : প্রভু যীশুর মাতা কুমারী মারীয়া যীশুর পিতা যোশেফের বাগদত্তা ছিলেন। মারীয়ার বিষয়ে যোশেফ জানতে পেরে তাঁকে গোপনে ত্যাগ করার মানস করলেন। যোশেফ এই সকল ভাবিতেছিলেন এমন সময় এক দূত স্বপ্নে তাঁকে দর্শন দিয়া কহিলেন যোশেফ দায়ুদ সন্তান, তোমার স্ত্রী মরিয়মকে গ্রহণ করিতে ভয় করিও না, কেনানা তাঁহার গর্ভে যাহা জন্মিয়াছে, তাহা পবিত্র আত্মা হইতে হইয়াছে, আর তিনি পুত্র প্রসব করিবেন এবং তুমি তাহার নাম যীশু (ত্রাণকর্তা) রাখিবে; কারণ তিনিই আপন প্রজাতিগকে তাহাদের পাপ হইতে ত্রাণ করিবেন।’ (পবিত্র বাইবেল-মথি; ১ অধ্যায় ১৯-২১ পদ)
‘দূত মরিয়মকে কহিলেন’ মরিয়ম ভয় করিওনা। কেননা তুমি ঈশ্বরের নিকটে অনুগ্রহ পাইয়াছ। আর দেখ তুমি গর্ভবতী হইয়া পুত্র প্রসব করিবে। তিনি মহান হইবেন, আর তাহার নাম যীশু রাখিবে। (পবিত্র বাইবেল লূক: ১ অধ্যায়, ৩০-৩১ পদ)
বাংলাদেশে বড়দিন : ডিসেম্বর মাস থেকে খ্রিস্টান সম্প্রদায় বড় দিনের প্রস্তুতি পর্ব শুরু করে এবং ২৫ ডিসেম্বরের পূর্বে ৪ সপ্তাহকে আগমনকাল হিসেবে চিহ্নিত করে আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। বড়দিনের ১ সপ্তাহ পূর্বে আধ্যাত্মিক প্রস্তুতির সাথে ক্যারল গান বা কীর্ত্তনের মাধ্যমে ঘরে ঘরে খ্রিস্টের আগমনী বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়।
২৪ ডিসেম্বর রাতের বিশেষ প্রার্থনায় খ্রিস্টের জন্মবারতা ঘোষিত হয়। বিভিন্ন পরিবারে ২৪ ডিসেম্বরের বিশেষ প্রার্থনায় যোগদানের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়ে থাকে। ২৫ ডিসেম্বর প্রার্থনায়ও অনেকে যোগদান করে। পরে বিভিন্ন গৃহে গিয়ে কুশল বিনিময় করে। বড়দিনের প্রীতি ও শুভেচ্ছা বিনিময় হয়। এই বিশেষ দিনটিতে ধনী নির্ধনী সবাই ভাল খাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে থাকে ও আত্মীয় প্রতিবেশী সবার বাড়ীতে শুভেচ্ছা বিনিময় করে। ছোট শিশুরা গোয়াল ঘর বানিয়ে খ্রিস্টের জন্মচিহ্ন রাখে এবং ক্রিসমাস ট্রি, ক্রিসমাস কার্ড দ্বারা, আলোকদ্বারা, কাগজের দ্বারা ঘর সাজিয়ে বড় দিনকে আরো আনন্দঘন করে থাকে।
অনেক পরিবারে পশ্চিমা ঐতিহ্যকে সামনে রেখে ‘ক্রীসমাস টি’ সাজানো হয় ছোটদের জন্য ‘সান্তাপাপা’ বানানো হয়। আনন্দানুষ্ঠানের জন্য শহরকেন্দ্রিক প্রায় পরিবারে কেকসহ হরেক রকম নাস্তার আয়োজন থাকে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে থাকে পিঠার সমাহার। বিভিন্ন গ্রামে যেখানে খ্রিস্টানদের আধিক্য বেশি সেখানে ২৪ ডিসেম্বর রাতে বিশেষ প্রার্থনার পর হয় কীর্ত্তন বা নাটক। এ ছাড়া ২৫ ডিসেম্বর থেকে সপ্তাহব্যাপী থাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা। এ দিনটি বিশ্বব্যাপী যেমন পালিত হয় তদ্রুপ বাংলাদেশেও আনন্দ উৎসবে পালিত হয়।
কিন্তু খ্রিস্টের জন্ম ও তাঁর ক্রুশীয় মৃত্যুর প্রকৃত তাৎপর্য মানুষের পাপ কালিমা মুছে যাওয়া, সৎ-জীবন যাপন, অন্যায় অত্যাচার বন্ধ করা, ন্যায্যতা আনায়নসহ পিতা ঈশ্বরের প্রতি গভীর বিশ্বাস স্থাপন করতে মানব জাতি ফি বছর পালন করছে বিশ্বব্যাপী শুভ বড়দিন উৎসব।
বাংলাদেশের খ্রিস্টান সম্প্রদায় : বাংলাদেশের খ্রিস্টান সম্প্রদায় দেশের সার্বিক উন্নয়ন কর্মকা-ে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। সকল পেশার মানুষই পেশাগত দায়িত্বে সকল পেশার মানুষই পেশাগত দায়িত্বে নিয়োজিত। অনেকে খ্রিস্টানদের বিদেশি বলে মনে করে থাকেন কিন্তু খ্রিস্টানরা ধর্মগতভাবে খ্রিস্টান হলেও তারা এদেশের আলো-বাতাসে গড়ে উঠা বাঙালি জাতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বঙ্গদেশে খ্রিস্টধর্মের গোড়াপত্তন : ঐতিহ্যগতভাবে এটা বিশ্বাস করা হয় যে, প্রভু যীশু খ্রিস্টের ১২ জন শিষ্যের অন্যতম সাধু টমাস ৫২ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ ভারতে আসেন এবং ৭২ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ ভারতে আসেন এবং ৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেখানে সাক্ষ্যমর (ধর্মশহীদ) হন। এ সময়ের মধ্যে তিনি স্থানীয় কিছু ইহুদীসহ বহু হিন্দু ব্যক্তিকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেন। তিনি ভারতের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলে ৭টি গির্জা স্থাপন করেন।
পর্তুগীজদের আগমন ও খ্রিস্টধর্মের বিস্তার : উত্তমাশা অন্তরীপ প্রদক্ষিণ করে ভাস্কো-দা-গামা ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতে পর্তুগীজ শক্তির গোড়াপত্তন করেন। পর্তুগীজ বসতিস্থাপনকারী ও ব্যবসায়ীদের সাথে ভারতে খ্রিস্টান মিনারীদের আগমন ঘটে। ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগীজরা সাতগাঁও (বর্তমানে হুগলীর নিকটবর্তী) ও চট্টগ্রামে বসবাস ও শুল্কগৃহ নির্মাণের অনুমোদন লাভ করেন। ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে মোঘল সম্রাট আকবর তাদেরকে বঙ্গদেশে স্থায়ী বসতি স্থাপন ও গির্জা নির্মাণের অনুমতি দেন। পর্তূগীজ বসবাসকারীরাই হলেন বাংলার প্রথম খ্রিস্টান, প্রথম দেশীয় খ্রিস্টানরা হলেন তাদের বংশধর। বাংলাদেশ ক্যাথলিক মন্ডলী গত ৪০০ বৎসর ধরে চলে আসছে। অন্যদিকে এই দেশে প্রটেষ্টান্ট মন্ডলী সমূহের বয়স ২০০ বৎসরেরও কম।
বাংলাদেশের সাতক্ষীরার (যশোর) নিকটবর্তী চন্ডিকা বা ঈশ্বরপুর নামক স্থানে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ক্যাথলিক গির্জা নির্মিত হয়। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে ২য় গির্জা নির্মিত হয় চট্টগ্রামে। (দিয়াং ও চট্টগ্রাম শহরে পারঘাটায়) ১৬১২ সালে ঢাকায় প্রথম পর্তুগীজ আগাষ্টিনিয়ান পুরোহিতগণ খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার শুরু করেন। ১৬২৮ সালে ঢাকার নারিন্দায় গির্জা নির্মিত হয়।
ঢাকার স্মৃতিময় তেজগাঁও গির্জা ১৬৭৭ সালে নির্মিত হয়। এছাড়া ঢাকার নগরীতে ১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে ও হাসনাবাদে ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে এবং বরিশালের পাদ্রী শিবপুরে ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে গির্জা নির্মিত হয়েছিল।
১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই পর্তুগীজ মিশনারীরা বাংলাদেশের শিক্ষা, সভ্যতা ও সামাজিক অবস্থার ভিত প্রস্তুত করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে থাকেন। ১৬৬৩-১৮৩৪ সাল পর্যন্ত বঙ্গদেশে খ্রিস্ট ধর্মের প্রভূত সম্প্রসারণ ঘটে। তবে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে যশোর জেলার ঈশ্বরপুরে জেটুইট মিশনারীদের দ্বারা নির্মিত প্রথম গির্জাটির ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান আছে।
বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালী জাতির শিক্ষার ক্ষেত্রে যে মনীষীর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে আছে তার কথাও সামান্য উল্লেখ করা প্রয়োজন। তিনি হলেন ড. উইলিয়াম কেরী। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি এ বঙ্গদেশে (কোলকাতায়) আসেন। ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি অবৈতনিক দৈনিক পাঠশালা খুলেন এবং হিন্দু ও মুসলমান যুবকদের জন্য মদনাবটিতে ১টি ও রামপাল দীঘিতে ১টি কলেজ স্থাপন করেন। তিনি ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে পবিত্র বাইবেলের নতুন নিয়মের গদ্য অনুবাদ করেন। ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি সম্পূর্ণ বাইবেলটি (পুরাতন ও নতুন নিয়ম) বাংলায় অনুবাদ করেন ও ছাপান।
ড. কেরী ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে একখান ছাপাখানা স্থাপন করেন ও ছাপার মান উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি শ্রীরামপুরে কলেজ স্থাপন করেন। তাঁর কর্মজীবন অবিভক্ত বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্মের আলো, প্রবর্তনের অবিস্মরণীয় ঘটনা। ড. কেরী ছিলেন প্রটেষ্টান্ট মন্ডলীর একজন নিবেদতি প্রচারক।
বাংলাদেশের ক্যাথলিক মন্ডলী : বাংলাদেশে ক্যাথলিক মন্ডলীর বিস্তৃতি অবস্থানে। বর্তমানে ক্যাথলিক মন্ডলী ৮টি ধর্ম প্রদেশে বিভক্ত।
ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশ : ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা ধর্মপ্রদেশ গঠিত হয়। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুলাই, ঢাকাকে মহাধর্মপ্রদেশের মর্যাদা দেয়া হয়। এ মহাধর্ম প্রদেশের বর্তমান কার্ডিনাল ও আর্চ বিশপ হচ্ছেন মহামান্য প্যাট্রিক ডি রোজারিও, সিএসি। এছাড়া ঢাকার সহকারী বিশপ হিসেবে আছেন বিশপ শরৎ ফ্রান্সিস গমেজ।
চট্টগ্রাম ধর্মপ্রদেশ : ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে, চট্টগ্রাম ধর্মপ্রদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এ ধর্ম প্রদেশের বিশপ হচ্ছেন মান্যবর মজেস মন্টু কস্তা, সিএসসি।
দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশ : ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে, এই ধর্মপ্রদেশ স্থাপিত হয়। এ ধর্মপ্রদেশের বিশপ হচ্ছেন মান্যবর সেবাষ্টিয়ান টুডু।
খুলনা ধর্মপ্রদেশ : ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জানুয়ারী, এ ধর্মপ্রদেশ স্থাপিত হয়। বর্তমানে এই ধর্মপ্রদেশের বিশপের জেমস রমেন বৈরাগী।
ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশ : ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ সেপ্টেম্বর, এ ধর্মপ্রদেশ স্থাপিত হয়। এ ধর্মপ্রদেশের বিশপ হচ্ছেন মান্যবর বিশপ পনেন কুবি, সিএসসি।
রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ : ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর এ ধর্মপ্রদেশে স্থাপিত হয়। এ ধর্মপ্রদেশের বিশপ হচ্ছেন মান্যবর বিশপ জেভার্স রোজারিও।
সিলেট ধর্মপ্রদেশ : ২০১১ খ্রিস্টাব্দের ৮ জুলাই থেকে সিলেট ধর্মপ্রদেশ যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে মান্যবার বিজয় ডি’ক্রুজ বিশপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বরিশাল ধর্মপ্রদেশ : ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে বরিশাল ধর্মপ্রদেশ যাত্রা শুরু করে। বিশপ হিসেবে আছেন লরেন্স সুব্রত হাওলাদার, সিএসসি।
সব বিশপদের পক্ষে কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি রোজারিও, সিএসসি মন্ডলী পরিচালনা করে থাকেন। ৮টি ধর্মপ্রদেশের ১০ জন বিশপ নিয়ে বাংলাদেশের বিশপ সম্মিলনী মহামান্য আর্চ বিশপকে সহায়তা করে থাকেন। মন্ডলী পরিচালনার ক্ষেত্রে। বিশপ সম্মিলনীর সিদ্ধান্তই মন্ডলী পরিচালনায় চূড়ান্ত বলে গণ্য হয়। বর্তমানে সকল বিশপই বাংলাদেশী। সম্প্রতি পোপ ফ্রান্সিস প্যাট্রিক ডি রোজারিও, সিএসসি নাম কার্ডিনাল হিসেবে ঘোষণা করেন।
অন্যান্য মন্ডলী : অন্যান্য মন্ডলীর মধ্যে প্রটেষ্টান্ট মন্ডলী ও ব্যাপ্টিস্ট মন্ডলী বাংলাদেশে আছে। ব্যাপ্টিস্ট মন্ডলী ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, খুলনা, বরিশাল, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জেলায় আছে। প্রটেষ্টান্ট মন্ডলী চার্চ অব বাংলাদেশ নামে পরিচিতি।
এছাড়া এসেমব্লিস্ অব গড চার্চ আছে ঢাকা ও অন্যান্য জেলায়। চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনা ও দুলাহাজারা (মালুমঘাট, কক্সবাজার সড়কে) হাসপাতাল ব্যাপ্টিস্ট মন্ডলী কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে। মাদার তেরেজার সম্প্রদায় মিশনারীজ অব চ্যারিটি ঢাকা, বরিশাল, খুলনা, যশোরে সেবামূলক কাজ করে থাকে। উল্লেখ্য ১৯৭১ সালে মুজিব নগরে মাদার তেরেজা বাঙ্গালী শরনার্থীদের সেবার জন্য সেবাশ্রম খুলেন। পরবর্তীতে প্রথমে খুলনায় ও পরে ঢাকায় ও অন্যন্যস্থানে সেবাশ্রম খোলা হয়।
সংগ্রাম স্বাধীনতা : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অনেকেই অংশ নিয়েছিল। খ্রিস্টান গ্রামগুলো ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল। এছাড়া জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল শরণার্থীদের জন্য শহর ও গ্রামে খ্রিস্টান পরিবারগুলো ছিল ছায়া স্বরূপ। এর খেসারত স্বরূপ বিক্ষুব্ধ পাক সেনারা ও তাদের দোসররা অনেক ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। খ্রিস্টানদের ক্লিনিকগুলো ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা কেন্দ্র। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাদের দেশপ্রেম, স্বার্থত্যাগ ও আত্মত্যাগের জন্য খ্রিস্টান সমাজ সত্যই গর্বিত ও গৌরাবান্বিত।
খ্রিস্টান জনসংখ্যা : বাংলাদেশ ক্যাথলিক জনসংখ্যা প্রায় ৫ লক্ষ ও প্রচেস্টান্ট জনসংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ। খ্রিস্টানদের শিক্ষার হার ৯০% যেখানে জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষার হার ৫৬% বেশি। দেশের মোট জন সংখ্যার ০০.০৩% হচ্ছে খ্রিস্টান। বিভিন্ন ব্যক্তি সূত্র থেকে জানা যায় (আসমর্থিত) বাংলাদেশের খ্রিস্টানদের মধ্যে উপজাতীয়রা দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট ও চট্টগ্রামে বাস করে। কিছু ইঙ্গ-ভারতীয় পরিবার আছে যারা ব্রিটিশ ও ভারতীয় অধিবাসীদের মধ্যে বৈবাহিক সূত্র ধরে এদেশে অবস্থান করছেন।
বাংলাদেশের খ্রিস্টানদের মাঝে পর্তুগীজদের স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে পদবী ও নাম এখনও আছে। যেমন গমেজ, ডি রোজারিও, কস্তা, ডি’কস্তা, পিউরীফিকেশন, পালমা, ছেড়াও প্রভৃতি। এছাড়া ধর্মন্তরিত অনেকে একটি খ্রিস্টধর্মের নাম ব্যবহার করলেও পদবী বাড়ৈ, দাস, সরকার, বিশ্বাস, পাল, রায়, হালদার, হাওলাদার ব্যবহার করে থাকে।
উপজাতীয়দের মধ্যে চাকমা, মারমা ত্রিপুরা কুমী, বোম কুকী, সাংমা, মানকিন রুরাম, তপ্ন মুর্ম্মু ও আরো অনেক পদবী আছে। বিবাহের সুত্রে যারা ইঙ্গ-ভারতীয় বলে দাবী করেন তারা নিজ বাড়ীতে নিজস্ব রীতিনীতিতে চলতে ভালবাসেন। তাবে স্বাধীন বাংলাদেশে সবাই এ দেশীয় এবং তাদের বর্তমান পরবর্তী প্রজন্ম ধীরে ধীরে পূর্বের ঐতিহ্যকে ডিঙ্গিয়ে বাংলাকে জীবনের সার্বিক কর্মকান্ডে জড়িত করছে।
মন্ডলীর কর্মীগণ : বাংলাদেশের মন্ডলী বহু বৎসর যাবৎ কর্মীদের দ্বারা (প্রচারক, ব্রাদার, ফাদার, সিস্টার) পরিচালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে প্রায় ৪০০ জন ফাদার ব্রাদার (দেশী ও বিদেশী) ও প্রায় ১২০০ জন সিস্টার (দেশী ও বিদেশী) এবং প্রায় ২০০ ব্রাদার মন্ডলীল কাজে নিয়োজিত। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সেবাকেন্দ্রে মন্ডলী বা চার্চের কর্মীগণ জড়িত। তবে এখনও মন্ডলী বা চার্চের কাজে উল্লেখযোগ্য বিদেশী কর্মী নিয়োজিত।
পোপ ফ্রান্সিস : বিশ্বব্যাপী বর্তমানে ক্যাথলিক মন্ডলী বা চার্চের প্রদান হচ্ছেন আর্জেন্টিনার অধিবাসী পোপ ফ্রান্সিস। স্বর্গীয় পোপ ২য় জন পল ১৯৮৬ সালের ১৯শে নভেম্বর বাংলাদেশে পালকীয় সফরে আসেন। ভাটিকান রাষ্ট্রের প্রধান হচ্ছে পোপ। তিনি একদিকে রাষ্ট্রপ্রধান অন্য দিকে ধর্মগুরু। প্রথম পোপ সাধু পিতরের পর ২৬৬ তম উত্তরাধিকারী হিসাবে আছেন বর্তমান ফ্রান্সিস।
মাদার তেরেজা : একজন সার্বজনীন মাতা হিসাবে মাদার তেরেজা সবার নিকট অতি পরিচিত নাম। শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার ও সম্মানে ভুষিত হন। তিনি পুরস্কারের সম্মানী দুঃস্থ ও অসহায়দের জন্য ব্যয় করেছেন। তিনি গরীব, অসহায় ও রোগীদের সেবাযতœ করেছেন নিঃস্বার্থভাবে। সম্প্রতি ভাতিকান থেকে ঘোষণা হয়েছে ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মাদার তেরেজা অব কোলকাতা নামে সাধ্বী হয়েছেন।
সেবামূলক কার্যক্রম : মন্ডলীর সঙ্গে সম্পৃক্ত বাংলাদেশ খ্রিস্টান এসোসিয়েশন, খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাষ্ট, ওয়াই.এম.সি.এ, ওয়াই.ডব্লিউ.সি.এ, সি.সি.ডি.বি, আর.ডি.আর.এস, সেবামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ক্যাথলিক মন্ডলী বা চার্চের বিশপদের পক্ষে সেবামূলক কার্যক্রমে ‘কারিতাস’ দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ডে অনন্য ভূমিকা রাখছে। কারিতাসের সেবা কাজ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্য নিবেদিত। আরেকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন অব বাংলাদেশ শিক্ষা ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
প্রকাশনা কার্যক্রম : পত্র পত্রিকা মানুষের হৃদয় মনের চিন্তা ও ভাবনার সৃজনশীল দর্পণ। প্রটেষ্টন্ট সম্প্রদায়ের ত্রৈমাসিক ‘সমতান’ও মাসিক ‘নবযুগ’ পাক্ষিক স্বর্গমত বিশেষ প্রসংসার দাবীদার। এছাড়া সাময়িকী হিসেবে মাসিক সমবার্তা, অনল, প্রদীপন, দীপ্তসাক্ষ্য, ন্যায্যতা, প্রতীতি, নীড় বিভিন্ন সংঘ সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়। সাপ্তাহিক ‘প্রতিবেশী’ এ বছর প্রকাশনার ৭৫ বছরে পদার্পণ করেছে। পত্রিকায় বিশ্বব্যাপী ও বাংলাদেশের মন্ডলীর খবরা-খবর সহ সুষ্ঠু ও রুচিশীল সাহিত্য চর্চা স্থান পায়। এটি পুরানো ঢাকার লক্ষীবাজার থেকে প্রকাশিত হয়। অনলাইন পত্রিকা বিডি খ্রিস্টান নিউজ। দৈনিক পত্রিকা আমাদের অর্থনীতিতে প্রতি মাসের শেষ রোববার প্রকাশ পায় খ্রিস্টীয় দর্পণ
উপসংহার : বাংলাদেশের খ্রিস্টানদের মাঝে বিভিন্ন পেশাধারীদের অবস্থান। রাজনীতিবাদ, সাংবাদিক, প্রশাসক, ব্যবসায়ী, আইনজীবি, শিক্ষক, চিকিৎসক, বৈজ্ঞানিক, প্রকৌশলী, নার্সসহ যাবতীয় পেশাজীবীর খ্রিস্টভক্তরা দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের ক্যাথলিক মন্ডলীর স্থানীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ভাবধারায় মন্ডলীর কাজ করে যাচ্ছে। যেমন বিবাহের পূর্বে গায়ে হলুদ বিবাহনুষ্ঠানের একটি অনন্য অংশ।
এছাড়া প্রার্থনা, গান বাংলায় করা, ধূপারতি, অর্ঘ্য প্রদান, প্রদীপ জ্বালানো সহ বহু আচার অনুষ্ঠানকে প্রধান্য দেয়া হচ্ছে। দ্বিতীয় ভাতিকান মাহাসভার দলিল সম্প্রতি মন্ডলী বাংলায় অনুবাদ করেছে। এর ফলে সাধারণ খ্রিস্টভক্তরা মন্ডলীর কাছে আরো সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবে। স্থানীয়ভাবে মন্ডলীর পরিচলনায় পুরোহিতদের সাথে খ্রিস্টভক্তদের অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
প্রায় ৪০০ বৎসর ধরে এ বাংলার বুকে খ্রিস্টধর্মের যে বীজ রপিত হয়েছিল তা আজ শুধু গাছে পরিণত হয়টি ফলও দিচ্ছে। তাই স্বাধীনতা সংগ্রামে খ্রিস্টানদের অংশগ্রহণ, শহীদ ফাদার ইভান্স (ঢাকা) ফাদার লুকাস মারান্ডী (দিনাজপুর), ফাদার মারিও ভেনেসিসি (যশোর), সিস্টার ইমানুয়েল সহ বহু খ্রিস্টভক্তের পবিত্র রক্ত চির ঋণী হয়ে থাকবে।
ক্যাথলিক মন্ডলীল অবদান আজ আনস্বীকার্য। বর্তমানে মন্ডলী দেশে ৬টি কলেজ, ৫০টি বিদ্যালয়, ২০০টি জুনিয়ার উচ্চ বিদ্যালয়, ৩৫০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কোচিং সেন্টার, ১০টি বৃত্তিমূলক শিক্ষা- প্রতিষ্ঠান, ১০টি হাসপাতাল, ২টি কুষ্ঠশ্রম, ১০০টি চিকিৎসা কেন্দ্র, ২টি প্রতিবন্দী শিশুদের আশ্রমসহ আরো বহু কার্যক্রম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপরোক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্য উন্মুক্ত। দেশ ও জাতি গঠনে খ্রিস্টান সমাজের অবদান দিন দিন বাড়ছেই।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বিডি খ্রিস্টিয়ান নিউজ