গুম, খুনের বাংলাদেশ
ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেন
যারা নিখোঁজ হয়েছিলেন তাদের অনেকেই ফিরে এসেছেন। তাদের কেউই মুখ খোলেননি। এ থেকে বোঝা যায়, তাদেরকে যারা অপহরণ করেছিল, তারা এমন ভয় দেখিয়েছে যে ভিকটিম কথা বলতেও ভয় পাচ্ছে। এবং যেভাবে এই গুমগুলো হয়, যেভাবে গুম থেকে ফেরত এসে তারা মুখ বন্ধ করে, তাতে আমাদের ধারণা করার কারণ রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটা অংশ জড়িত থাকতে পারে। অথবা তারা যদি জড়িত না থাকে, তাহলে শক্তিশালী কোনো একটা গ্রুপ বাংলাদেশে আছে, যারা এই গুমের ঘটনা ঘটাচ্ছে। যেভাবেই গুম হোক না কেন, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে তদন্ত করে দেখা। কিভাবে গুম হল, স্বেচ্ছায় লুকিয়ে আছে কি না? অথবা কেউ তাকে চাঁদাবাজির জন্য অপহরণ করেছে কি না? অথবা অন্য কোনো কারণে অপহরণ করেছে কি না? সে সবগুলো বিষয় খতিয়ে দেখার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। এটা বের করতে না পারা রাষ্ট্রের চরম ব্যর্থতা। আমরা দেখতে পাই, যেখানে রাজনীতি অথবা যেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত রয়েছে, সেগুলোর কোনো সুরাহা হয় না। উদাহরণস্বরূপ যদি বলি, অ্যাডভোকেট রেজওয়ানা হাসানের স্বামী যখন অপহরণ হয়েছিল। পরে তাকে ছেড়ে দিয়েছিল। এই ঘটনায় জড়িতদের খোঁজে পাওয়া যায়নি। তাদের কোনো বিচার হয়নি। তাদেরকে যদি খোঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া যেত, তাহলে আজকের এই গুমের ঘটনা অনেক কমে যেত। আমরা কি বলব রেজওয়ানার স্বামীকে যারা গুম করেছিল, তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেয়েও শক্তিশালী? তারা যদি এত শক্তিশালী হয়, তাহলে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বই তো তাদেরকে দেওয়া যায়। জনগণের নিরাপত্তা দিতে পারতে হবে রাষ্ট্রকে। ডিবি অনেককে ধরে নিয়ে যায়। ধরে নিয়ে তারপর দশ লক্ষ বা বিশ লক্ষ টাকা চায়। টাকার যখন সুরাহা হয়, একটা সময় পরে তাদেরকে ছেড়ে দেয়। আর যদি বেশি বেকায়দায় পড়ে, তখন একটা পেন্ডিং মামলা দিয়ে তাদেরকে পাঠানো হয়। আমাদের ধারণা করার কারণ রয়েছে, এই যে চাঁদাবাজিটা হয়, এই টাকার অংশ পুলিশের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পকেটে যায়। নাহলে এদের জবাবদিহিতা হবে না কেন? তাদেরকে কারা অপহরণ করে এবং এমন ভয় দেখায় যে, ফিরে এসে তারা আর মুখ খোলে না। এই জায়গায় রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। আমি মনে করি, এই চাঁদাবাজির সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটা অংশ জড়িত। কখনোই কোনো একটা লোককে ছয় মাস আটকে রাখা সম্ভব নয়। কিছু কিছু লোক ফেরত এসেছে। কিন্তু আমরা জানি, অনেকে ফেরত আসে নাই। ইলিয়াস আলি, চৌধুরী আলম, মীর কাসেমের ছেলে ব্যারিস্টার, ব্রিগেডিয়ার আজমি, কর্নেল সাহেবের ছেলে সা’দাত। আমরা এখনো জানি না, তারা জীবন নিয়ে ফেরত আসবে কিনা? যারা ফেরত আসছে তারা ভালো থাকুক। তাদের যদি জেরা না করা হয়, যারা এই ঘটনার পিছনে বিচারের সম্মুখীন না করা হয়, তাহলে সবাই বিপদে আছি। আজকে হয়তো অনেকে ভাবতে পারে যে, তারা নিরাপদ, কিন্তু তারাও এক সময় এই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, স্বাধীনতার ৪৭ বছরে আমরা দেখতে পাচ্ছি, যে এই দেশে সেই কুখ্যাত দক্ষিণ আমেরিকায় যেটা ১৯৬০ এ হয়েছে, যে দেশের নাগরিক গুম হচ্ছে, সেটা আমাদের দেশে ফেরত এসেছে। দেশের মানুষ এটা দেখতে চায় না। দেশের মানুষ দেখতে চায়, বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুশাসন নিশ্চিত হয়েছে। আজকে বাক স্বাধীনতা সম্পূর্ণভাবে ভুলুন্ঠিত। যতটুকু কথা মানুষ সাহস নিয়ে বলে, তারাও ভয়ে ভয়ে বলে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলেও গুম হয়েছিল। সে ফেরত আসার পরে একটি কথাও বলে নি। ভয়াবহ সন্ত্রাসী কার্যক্রম চলছে। এমন একটা ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যে, এসে তারা ভয়ে কোনো মুখ খোলে না। এই রাষ্ট্রের দায়িত্ব এর সঠিক তদন্ত করা। এবং যারা এই অপরাধ করেছে, তাদেরকে খোঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।
পরিচিতি : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টও সাবেক সেনা কর্মকর্তা
মতামত গ্রহণ : সানিম আহমেদ
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ