লাশের মিছিলে ২৯ সাংবাদিক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম প্রধান
শ্বাসরুদ্ধ এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি সাংবাদিক সমাজ। আইন, কালা-কানুন, পেশিশক্তি আর সন্ত্রাসী গোষ্ঠী পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। যে কারণে সাহসী, অনুসন্ধানী ও নিখুঁত সাংবাদিকতা মুখথুবড়ে পড়েছে। এসব আপদ হয়ে দেখা দিয়েছে স্বাধীন ও মুক্ত পথে সাংবাদিকতা চর্চার পথে। পেশাটি আজ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে সর্বজন স্বীকৃতি ও পরিচিতি পাচ্ছে।
সাংবাদিক নির্যাতন-হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার না হওয়ায় আমাদের দেশে এ পেশার লোকজন আজ চরম হুমকির মুখে। পেশাগত দায়িত্ব পালনে তারা পদে পদে বাধার সম্মুখীন। দেশের পাঠকপ্রিয় দৈনিকের সাংবাদিকদের সরকার প্রধানের অনুষ্ঠানে যেতে দেওয়া হয় না। পাঠকের আস্থাশীল ও দর্শকপ্রিয় অসংখ্য গণমাধ্যম বছরের পর বছর বন্ধ করে রাখা হয়েছে সাময়িকের কথা বলে। ফলে সচেতন মহলে সাময়িক শব্দটির সংজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, চ্যানেল ওয়ান, সিএসবি, ইসলামিক টিভির পর একসঙ্গে ৩৫টি অনলাইন পোর্টাল বন্ধ করে দেওয়ায় হাজার হাজার সাংবাদিক বেকার হয়ে পড়েন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে পরিবার পরিজন নিয়ে তারা দিশেহারা। যারাও বা পেশায় আছেন, তাদের অবস্থা আরো সঙ্গীণ। অন্য পেশাদার বেতন-ভাতা ১২৩ গুণ বৃদ্ধি পেলেও সাংবাদিকদের ওয়েজ বোর্ডের মেয়াদ অনেক আগে পেরিয়ে গেলেও তা আলোর মুখ দেখছে না। ফলে দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে কর্মরত সাংবাদিকরাও কষ্টকর জীবন কাটাচ্ছেন।
সাগর-রুনি দম্পতি হত্যার পর খুনিদের গ্রেফতাদের দাবিতে সাংবাদিক সমাজসহ সচেতন জনগোষ্ঠী সোচ্চার হয়। তার পরও চিহ্নিত খুনিরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকায় সাংবাদিক নির্যাতন ডালভাতে পরিণত। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শওকত মাহমুদসহ সাংবাদিক নেতারাও আজ জেল-জুলুমের শিকার। আমার দেশের নির্ভীক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, যায়যায়দিনের সাবেক সম্পাদক শফিক রেহমান, এনটিভির কর্ণধার আলহাজ মোসাদ্দেক আলী ফালু, ইটিভির কর্ণধার আবদুস সালাম, বিশেষ প্রতিনিধি ড. কনক সরোয়ার, ডিইউজের নেতা ও সদস্য রফিক মুহাম্মদ, আতিকুর রহমান, রবিউল্লাহ রবি, রাজু আহমেদ, হেলালসহ অর্ধশতাধিক সাংবাদিক জেলে যান। হামলা-মামলার হয়রানিসহ নির্যাতনের শিকার হন সহ¯্রাধিক সাংবাদিক।
পরিসংখ্যান বলছে, চিহ্নিত একটি মহল ক্ষমতায় এলে সাংবাদিক নির্যাতন বাড়ে। অন্যদের সময়ে সেটা অনেকটা নিরাপদ থাকে। গত আট বছরে সারা দেশে ২৯ জন সাংবাদিক নিহত হন। পেশাগত কারণে এসব হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে বলে মনে করেন সাংবাদিক সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। যাদের বিচার পাচ্ছেন না পরিবার ও সহকর্মীরা। বিচারকাজে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে বলে মনে করেন তারা।
আট বছরে নিহত সাংবাদিকদের নাম-পরিচয় নিয়ে অনেকেই মাঝে-মধ্যে প্রশ্ন করেন। তাদের প্রশ্নের উত্তর এখানে মিলবে বৈকি। পেশার প্রতি নিবেদিত নিহত হতভাগা সেই সাংবাদিকদের নাম, তারিখ ও সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরছি : ১. আতিকুল ইসলাম আতিক, মৃত্য ফেব্রুয়ারি ২০০৯ – ঢাকার মগবাজার, ভিডিও এডিটর- এনটিভি; ২. নূরুল ইসলাম রানা, মৃত্যু ৩ জুলাই ২০০৯, ঢাকার উত্তরায়, সন্ত্রাসী হামলায় নিহত, স্টাফ রিপোর্টার- পাক্ষিক মুক্তমন; ৩. এম এম আহসান হাবীব বারী, মৃত্যু ২৬ আগস্ট ২০০৯, গাজীপুরে, দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে, নির্বাহী সম্পাদক- সাপ্তাহিক সাস্প্রতিক সময়; ৪. আবদুল হান্নান, মৃত্যু ২ অক্টোবর ২০০৯, ঢাকার ডেমরার রামুইল সড়কের রাতখাঁর কল এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলীতে, স্টাফ রিপোর্টার- দৈনিক রূপালী দেশ; ৫. আবুল হাসান আসিফ, মৃত্যু ২ ডিসেম্বর ২০০৯, রূপগঞ্জে, রূপগঞ্জ প্রতিনিধি- দৈনিক ইনকিলাব এবং সহ-সভাপতি রূপগঞ্জ প্রেস ক্লাব; ৬. ফতেহ ওসমানী, ১৮ এপ্রিল ২০১০ আহত হওয়ার পর ২৮ এপ্রিল মৃত্যু সিলেটে, দুর্বৃত্তদের হামলায় নিহত, সিলেট প্রতিনিধি- সাপ্তাহিক ২০০০; ৭. শফিকুল ইসলাম টুটুল, মৃত্যু ৯ মে ২০১০, ঢাকায়, গুপ্তহত্যাকা-, ক্যামরাপার্সন- এটিএন বাংলা; ৮. মনির হোসেন রাঢ়ী, মৃত্যু ২৩ ডিসেম্বর ২০১০, বরিশালের মুলাদীতে, প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা, সভাপতি- মুলাদী প্রেস ক্লাব, ৯. ফরহাদ খাঁ, মৃত্যু ২৮ জানুয়ারি ২০১১, ঢাকার নয়াপল্টন জবাই করে সস্ত্রীক হত্যা, সহ-সম্পাদক- দৈনিক জনতা; ১০. মাহবুব টুটুল, মৃত্যু ৭ এপ্রিল ২০১১, চট্টগ্রাম পোর্ট কলোনী লাশ পাওয়া যায়, দৈনিক আজকের প্রত্যাশা ও সাপ্তাহিক সংবাদচিত্র; ১১. আলতাফ হোসেন, খুন ৭ এপ্রিল ২০১১, ঢাকার উত্তরা ৪নং সেক্টরে নিজ বাসায় লাশ পাওয়া যায়, সাপ্তাহিক বজ্রকন্ঠ; ১২. ফরিদুল ইসলাম রঞ্জু, নিহত ৭ ডিসেম্বর ২০১১, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ জবাই করে হত্যা, জেলা প্রতিনিধি- দৈনিক ভোরের ডাক; ১৩. সাগর সরওয়ার, খুন ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১২- রাজাবাজার, ঢাকা নিজ বাসার বেড রুমে, বার্তা সম্পাদক- মাছরাঙ্গা টিভি; ১৪. মেহেরুন রুণী, খুন ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১২, রাজাবাজার, ঢাকায় নিজ বেড রুমে, সিনিয়র রিপোর্টার- এটিএন বাংলা; ১৫. জামাল উদ্দিন, খুন ৫ জুন ২০১২ বেনাপোল যশোরে, দুর্বৃত্তদের গুলীতে, শার্শা প্রতিনিধি, গ্রামের কাগজ; ১৬. জুনায়েদ আহমদ জুনেদ, খুন ১০ জুলাই ২০১২, হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে, স্টাফ রিপোর্টার- দৈনিক বিবিয়ানা; ১৭. তালহাদ আহমদ কাবিদ, খুন ২৩ অক্টোবর ২০১২, নরসিংদীতে, অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের হামলায়, স্টাফ রিপোর্টার- নরসিংদীর বাণী; ১৮. মাহমুদুল হাসান তারেক, ১৫ জানুয়ারি ২০১৩, তেজগাঁও এফডিসি রেলক্রসিংয়ে, রহস্যজনভাবে খুন, শিক্ষানবিশ স্টাফ রিপোর্টার- নিউএজ ও ঢাবি শিক্ষার্থী, ১৯. দুর্জয় চৌধুরী দিপু, খুন ১৬ জানুয়ারি ২০১৩, ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে নিজ অফিসে, সন্ত্রাসীদের গুলীতে, যুগ্ম সম্পাদক- সাপ্তাহিক অপরাধ দমন; ২০. ফারুক আহমেদ, খুন ১৯ জানুয়ারি ২০১৩, টাঙ্গাইলে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত, সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক; ২১. আফতাব আহমেদ, খুন ২৪ ডিসেম্বর ২০১৩, ঢাকার পশ্চিম রামপুরা ওয়াপদা রোডের নিজ বাড়িতে, একুশে পদকপ্রাপ্ত ফটো সাংবাদিক- সাবেক দৈনিক ইত্তেফাক; ২২. শাহ আলম সাগর, খুন ২ মার্চ ২০১৪, উত্তরা পশ্চিম থানার ছাদ থেকে ফেলে হত্যা, থানার ওসিসহ পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগে মামলা, স্টাফ রিপোর্টার- সাপ্তাহিক অপরাধ দমন; ২৩. দেলোয়ার হোসেন, খুন ২৮ মার্চ ২০১৪, নারায়নগঞ্জ প্রতিনিধি- দৈনিক সমাচার, ২৪. মুশফিকুর রহমান তুহিন, খুন ৮ অক্টোবর ২০১৫, নেত্রকোনায় দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে, জেলা প্রতিনিধি- সাপ্তাহিক অপরাধ জগত; ২৫. আওরঙ্গজেব সজীব, খুন ২৩ ডিসেম্বর ২০১৫, নিখোঁজের পর ধলেশ্বরী নদী থেকে লাশ উদ্ধার, ঢাকা মেডিক্যাল প্রতিনিধি- ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি ও বাংলাদেশ প্রতিদিন, মেডিকেল রিপো, অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি; ২৬. মশিউর রহমান উৎস, খুন ২৪ ডিসেম্বর ২০১৫, দৈনিক যুগের আলো- রংপুর; ২৭. আবু সায়েম, জুলাই ২০১৫, চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে খুন, জীবননগর প্রতিনিধি- দৈনিক সমকাল, ২৮. আবদুল হাকিম শিমুল, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শাহাজাদপুর সিরাজগঞ্জ, গুলি করে হত্যা; প্রতিনিধি- দৈনিক সমকাল; ২৯. আবুল কালাম আজাদ, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, বুড়িচং, কুমিল্লায় দুর্বৃত্তদের হামলায় নিহত, বুড়িচং প্রতিনিধি- যুগান্তর এবং নির্বাহী সদস্য বুড়িচং প্রেস ক্লাব।
সাংবাদিক হত্যা, নির্যাতনের এই মিছিল থামানো জরুরি। আইনের জালে বন্দী না করে পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে কীভাবে আরও গণমুখী করা যায়, সে ব্যাপারে ভাবাই অধিক যুক্তিযুক্ত। সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার নিশ্চি করা সময়ের দাবি। সে দাবি পুরণে ক্ষতাসীনরা আন্তরিক হলে এর পুনরাবৃত্তি ঘটানোর সাহস পাবে না দুর্বৃত্তসমরা। মুক্ত ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পথ উন্মুক্তকরণে বাধার প্রাচীর হিসেবে পরিচিত আইন ও কালাকানুন তুলে নেওয়া হোক।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ