ফেরা না ফেরার কাব্য
‘ম্যাড ফ্রাইডে’ফেরা না ফেরার কাব্য লিখতে বসেছি। অবশ্য আমার আগেই লিখেছেন প্রিয় এবং খ্যাত সাংবাদিক সালেহ বিপ্লব, ‘লুঙ্গির পর ধূতি ফিরে পেলুম! ধূতির কাছা বাঁধতে না বাঁধতেই প্যান্ট ফিরে এলো! খুব ভাল্লাগছে।’ প্রথিতযশা গণমাধ্যমের আরেক নিউজ এডিটর লিখলেন, ‘যেভাবেই মানুষগুলো ফিরে আসুক না কেন, বেঁচে আছেন এটাই ভাল খবর’। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত তাদের কথার পর আসি ‘ফিরে আসা’ মানুষগুলোর প্রিয়জনদের আলাপে। সবার কথামালা অনেকটা একই রকমের। বলতে পারেন একই বিন্যাসে সাজানো বাক্য, ‘আমাদের কারো প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। তারা ফিরে এসেছে তাতেই আমরা খুশি।’ হ্যাঁ নিখোঁজ থাকা মানুষদের ফিরে আসার কাব্য বিষয়ে বলছি। উৎপল ফিরেছে, ফিরেছেন মোবাশ্বের, নিখোঁজ আমিনুল ফিরে রিমান্ডে। এর আগেও যারা ফিরেছেন তাদের ‘ফেরা বিষয়ক’ মনস্তত্ব নিয়েই যোগাযোগ মাধ্যমে স্বল্প বাক্যে অনেক বড় কথা লিখেছেন প্রিয়জন দুই সাংবাদিক।
কী আছে ওনাদের লেখায়, ভালো খবরে কী আছে, আশা? প্যান্ট ফিরে আসাতে, রম্য? আশা বা রম্য! কী আছে? বাক্যগুলো ভেঙ্গে ভেঙে খুলে খুলে দেখুন, দেখবেন সব ছাপিয়ে রয়েছে অব্যক্ততার বিক্ষুব্ধতা, প্রতিরোধহীনতার যন্ত্রণা আর স্বপ্নভঙ্গের বিষাদ আনুষঙ্গ। এর বাইরে কিছু নেই। আর ‘ফেরা’দের প্রিয়জনের কন্ঠ ধারণ করেছে অসহায়ত্ব, ¯্রফে না ফেরার আশঙ্কিত যন্ত্রণাকাতর অবয়ব লুকানোর প্রয়াস। সামাজিক নিরাপত্তা ক্রমেই ভেঙে পড়ছে। গণমাধ্যমে দেখলাম স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে কিশোরী ধর্ষিতা। না, এটাই একমাত্র নয়, এমন ঘটনা প্রতিদিনের। বন্ধুকে মেরে নিজ শোবার ঘরে পুতে রাখার ঘটনাও দেখেছি, পড়েছি গণমাধ্যমে। মানুষ কেন এমন ক্রুর হয়ে যাচ্ছে, নিষ্ঠুর হচ্ছে, এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বুঝতে হবে সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি। একটি মেয়ে বা ছেলে কোনো অবৈধ কর্মে জড়ালে সমাজ তাকে তিরস্কার করে। যার ফলেই কেউ একজন অপরাধ প্রবন হওয়ার আগে দশবার ভাবে। তিরস্কার আর পুরস্কার দুটো কারণেই সমাজ টিকে থাকে, মানুষ নিরাপদ থাকে। আইন বলেন বা ধর্ম, সবখানেই তিরস্কার আর পুরস্কার কে মাথায় রেখেই সামাজিক, রাষ্ট্রীয়সহ সকল নিরাপত্তার চিন্তা করা হয়। সমাজও নিজ ভাবনায় এমন নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলে। আর এটাই সামাজিক নিরাপত্তা।
কখন গণমাধ্যমে প্রতিদিন উঠে আসে ধর্ষণ, খুন, সংঘাত আর সংঘর্ষের সংবাদ এমন প্রশ্নের উত্তরটা সহজ, যখন সামাজিক নিরাপত্তা বিপন্ন হয়। কারণ, প্রায়োগিক নিরাপত্তার প্রথম ও মূল ধাপটি তৈরি করে সমাজ, তারপর তা দেখভালের দায়িত্ব নেয় রাষ্ট্র। ‘কেন বিপন্ন হয়’ এর উত্তরটাও খুব কঠিন নয়। এক কথায় বলা যায়, সমাজ নেতৃত্বে যখন পঁচন ধরে, সামাজিক ব্যবস্থায় যখন জেকে বসে সুবিধাবাদ তখন নিরাপত্তা বিপন্ন হয়। পঁচা আর সুবিধাবাদী নেতৃত্ব নিজ সুবিধায় উটপাখির মতন বালিতে মুখগুজে থাকে, আর নৈরাজ্যবাদীরা চালায় নৈরাজ্য।
মানুষ আর পশুদের অনেক পার্থক্যের প্রধানতম হলো, অনেক পশুই নিজ সন্তানকে হত্যা করে, অনেক পশু স্বজাতিকে হত্যা করে নিজ ক্ষুধা মেটায়। মানুষ সেটা পারে না বলেই ‘মানুষ’। মানবিকতা আর পাশবিকতার পার্থক্যটা এখানেই। ইদানিংকালে এমন পার্থক্যের ফারাকটা ক্রমেই কমে আসছে। গণমাধ্যমে প্রায়ই দেখছি, পরকিয়াসহ নানা কারণে ‘মা’ অথবা ‘বাবা’ সন্তানকে হত্যা করেছে। ‘মা’ শব্দটি ধর্ম, আইন, সমাজ সবখানেই সর্বোচ্চ সম্মানিত, ‘বাবা’ শব্দটি নির্ভরতার প্রতিক। সামাজিক নিরাপত্তা কতটুকু বিপন্ন হলে, অসভ্যতা কতটা বল্গাহীন হলে এমন ঘটনা ঘটে, ভাবতে পারেন! যারা ভাবতে পারেন না, তাদের নিরাপত্তা সম্পর্কেই কোনো ধারণা নেই।
ধারণাহীনদের জন্য ‘ম্যাড ফ্রাইডে’র কথা বলি। বড়দিনের আগের শুক্রবারকে বলা হয় ‘ম্যাড ফ্রাইডে’, অন্য কথায় ‘মাতাল শুক্রবার’। লন্ডনের খ্যাত অনলাইন মাধ্যম ‘দ্য ডেইলি মেইল’ এবারের ‘মাতাল শুক্রবার’ নিয়ে বলেছে, ‘ম্যাড ফ্রাইডেতে বেসামাল হয়ে পড়েছে বৃটেন। মাতলামো এতই বেড়ে গিয়েছিল যে, মদ্যপদের আক্রমনে তিন পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হয়েছেন, একজনের হাত ভেঙ্গে গেছে, আরেকজনের মাথার আঘাত গুরুতর।’ ম্যাড ফ্রাইডে’র ম্যাড’দের বিষয়ে ‘মেইল’ আরো বলেছে, ‘তাদের পোশাক কোথায় কিভাবে আছে সেদিকে খেয়ালই ছিল না। অনেকের পরিহিত পোশাকে স্পর্শকাতর অঙ্গগুলো দৃশ্যত অনাবৃত হয়ে পড়ে।’ ‘ডেইলি মেইলে’র ভাষ্যে মদপানের অনুষ্ঠান ও পরবর্তী পরিস্থিতি চলে গিয়েছিল আয়ত্বের বাইরে।
আমাদের পরিকাঠামোতেও ‘ম্যাড ফ্রাইডে’র আছর পড়েছে। ক্রমেই ‘ম্যাড’দের প্রভাব বাড়ছে, বাড়ছে নিরাপত্তাহীনতা। পরিস্থিতি আয়ত্বের বাইরে চলে যাবার ‘রিস্ক’ নিবেন কী না, তা ভাবতে হবে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্ণধারদের।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ