বিদ্যালয়ে চলন্ত সিঁড়ি না চলন্ত দুর্নীতি!
মোহাম্মদ আবু নোমান : ‘এই চলন্ত সিঁড়ি দুই পয়সারও কাজে আসবে? কি লজ্জার খবর…’? আমি বললাম ‘ভাই, লজ্জা-লজ্জা করেন! লজ্জা পান কেন? লজ্জা না পেলে হয় না…’? এই লেখককে জনৈক শুভাকাক্সক্ষী এভাবেই কথাগুলো বলেন। দেশে শিক্ষার মানের অভাব, প্রশিক্ষণের অভাব, শিক্ষা উপকরণের অভাবের সাথে শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষকস্বল্পতা, যা কোনো নতুন খবর বা ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। এটাই হচ্ছে বিদ্যালয়গুলোর গড়পড়তা চিত্র। নতুন যে খবর তা হলো- সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চলন্ত সিঁড়ি (এস্কেলেটর) বসানোর প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ১১৬ কোটি টাকার বিশাল ব্যয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ১৬৩টি বিদ্যালয়ে এই এস্কেলেটর স্থাপন করার প্রস্তাব দিয়েছে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। একনেকে প্রকল্পটি পাস হতেও দেরি হয়নি। দপ্তরি আর ১ জন শিক্ষককে নিয়ে পুরো বিদ্যালয় সামাল দেওয়া; বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে পলেস্তারা খসে পড়া; চেয়ার, টেবিল, বেঞ্চ যার বেশিরভাগই ভাঙা; সুরকি ওঠা ব্ল্যাকবোর্ড; পর্যাপ্ত ডাস্টার, চক নেই; অসংখ্য বিদ্যালয় আছে যেখানে টিউবওয়েল নেই; বাথরুম নেই- আবার থাকলেও বদনা নেই। চর বা পার্বত্য অঞ্চলের অবস্থাতো আরও খারাপ। জরাজীর্ণ ঘরের সাথে বেড়া ভাঙা থাকায় যেখানে শত শত স্কুল বর্ষাকালে গোয়ালঘরে রূপান্তরিত হয়, সেই আমরাই ১১১৬ কোটি টাকা খরচ করে চলন্ত সিঁড়ির কথা ভাবি! বলা হয়, গরিবের ঘোড়া রোগ। আমাদের সংশ্লিষ্টদের অবস্থা হল- লুঙ্গীর সাথে টাই পরে ভদ্রলোক সাজার চেষ্টা!
এবার দেখা যাক শিক্ষার মানের হাল- প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মনিটরিং বিভাগ (এনএসএ)-এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলায় শতকরা ৭১ ও গণিতে ৬৮ ভাগ শিশুই তার যেটুকু পারার কথা, তা পারে না। তাহলে ৭০ শতাংশ শিশু প্রায় কোনো কিছু না শিখেই মাধ্যমিকে চলন্ত সিঁড়ি বানিয়ে দিলে কি আমাদের এসব শিক্ষার্থী বাংলা ও গণিতে যোগ্যতা অর্জন করে ফেলবে? না এসব ঢাকতে, দুনিয়াকে দেখাতে দেশে দৃষ্টিনন্দন চলন্ত উন্নয়নের সিঁড়ি দরকার? যদি তা না হয়, তাহলে এই ১১১৬ কোটি টাকা ব্যয়ের চলন্ত সিঁড়ি কি ‘চলন্ত দুর্নীতি’ বা হরিলুটের খোরাক হবে না? শিক্ষকের ১০০ ভাগ বেতন বাড়ানোর সুফল হলো- শিক্ষকদের পড়ালেখা শেখানোর দায়িত্ব অভিভাবকদের উপর চাপিয়ে দেওয়া; নোট, গাইড, ডাইরি, ড্রেস ও কোচিং ব্যবসা, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে পরীক্ষায় পাশ করানোরও দায়িত্ব যখন শিক্ষকরা নিয়েছেন। যেখানে পড়াশোনাই চলে না, আবার পা চলার জন্য চলন্ত সিঁড়িও যদি না থাকে তাহলে রাষ্ট্রের টাকা লুটের চলন্ত প্রক্রিয়া কিভাবে সম্ভব! নতুন পে-স্কেলধারী আরাম প্রিয় শিক্ষকদের কস্টের কথা চিন্তা করে কি চলন্ত সিঁড়ি বসানোর চিন্তা? নাকি প্রশ্নফাঁসে ভর্তি ও গজ, বেন্ডেজ, কাঁচি, রোগির পেটে রেখে সেলাই করা ডাক্তারের মতো মেধাবিহীন জাতি এই সিঁড়ি ধরে উপরে উঠবে! কেননা দেশকে এগিয়ে নিতে হলে কিছুতো একটা করার চিন্তাতো করতেই হবে!
শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের বোঝা উচিত- ছাত্র-ছাত্রীদের সুন্দর, সুষ্ঠু, স্বাভাবিক পরিবেশ দরকার, উচ্চাবিলাষী জীবন ব্যবস্থা নয়। মেধা অর্জন ও ধারণকে বাদ দিয়ে অলস, সৌখিন, আরাম, স্টাইলই এবং সুদর্শনা ভাব ধরে জাতির উন্নতি হবে না। কেননা যেভাবে ভর্তি ও চাকুরিতে প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে এভাবে চললে, ফল পেতে খুব বেশি দেরি করতে হবে না।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ