
প্রতিমা পূজার মাহাত্ম নিতাই চাঁদ তালুকদার এফ.সি.এ
মানুষের মন স্বভাবতই চঞ্চল। পার্থিব জগতে আমাদের চঞ্চল মন নানা কামনা বাসনা দিয়ে আবদ্ধ। আমরা চাইলেই এই কামনা বাসনা বা কোনো কিছু পাবার আকাঙ্খা থেকে মুক্ত হতে পারি না। তীব্র গতির এই মনকে সংযত করা, স্থির করার ব্যবস্থা করা হয় এই সগুণ ঈশ্বরের বিভিন্ন রূপের মাধ্যমে।
মনে রাখতে হবে আমরা কখনই ঈশ্বরের বিশালতা বা অসীমতাকে আমাদের সসীম চিন্তা দিয়ে বুঝতে পারব না। বরং সর্বগুনময় ঈশ্বরের কয়েকটি বিশেষ গুণকেই বুঝতে পারব। আর এ রকম এক একটি গুনকে বুঝতে বুঝতে হয়ত কোনো দিন সেই সর্ব গুণময়কে বুঝতে পারব। আর মূর্তি বা প্রতিমা হল এসকল গুণের রূপকল্প বা প্রতীক। এটা অনেকটা গণিতের সমস্যা সমাধানের জন্য ‘ এক্স ’ ধরা। আদতে এক্স কিছুই নয় কিন্তু এক্স ধরেই হয়ত আমরা গণিতের সমস্যার উত্তর পেয়ে যাই। অথবা ধরুন জ্যামিতির ক্ষেত্রে আমরা কোনো কিছু বিন্দু দিয়ে শুরু করি। কিন্তু বিন্দুর সংজ্ঞা হল যার দৈর্ঘ, প্রস্থ ও বেধ নাই কিন্তু অবস্থিতি আছে – যা আসলে কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। অথচ এই বিন্দুকে আশ্রয় করেই আমরা প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতা থেকে হিমালয়ের উচ্চতা সব মাপতে পারি। আবার ধরুন, ভূগোল পড়ার সময় একটি গ্লোব রেখে কল্পনা করি এটা পৃথিবী আবার দেয়ালের ম্যাপ টানিয়ে বলি এটা লন্ডন, এটা ঢাকা, এটা জাপান। কিন্তু ঐ গ্লোব বা ম্যাপ কি আসলে পৃথিবী ? অথচ ওগুলো দেখেই আমরা পৃথিবী চিনেছি।
তেমনি প্রতিমা রূপ কল্পনা বা প্রতিমা স্বয়ং ঐসকল দেবতা নন তাঁদের প্রতীক, চিহ্ন বা রূপকল্প। এগুলো রূপকল্প হতে পারে কিন্তু তা মনকে স্থির করতে সাহায্য করে এবং ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণ সম্পর্কে ধারণা দেয়, শেখায় ঈশ্বর সত্য। সব শেষে পরম ব্রহ্মের কাছে পৌঁছাতে সাহায্য করে।
সনাতন ধর্মে পূজা একটি বৈশিষ্ট্য। কল্পনায় দাঁড়িয়ে সত্য উত্তরণই পূজার সার্থকতা। আমাদের ধর্মে ঈশ্বরের নিরাকার ও সাকার উভয় রূপের উপাসনার বিধান আছে। নিরাকার ঈশ্বরের কোনো প্রতিমা নাই, থাকা সম্ভবও না। যারা ঈশ্বরের অব্যক্ত বা নিরাকার উপাসনা করেন তাঁদের বলে নিরাকারবাদী। আর যারা ঈশ্বরের সাকার রূপের উপাসনা করেন তাঁরা সাকারবাদী। এজন্য গীতায় বলা আছে, যারা নিরাকার, নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসনা করেন তারাও ঈশ্বর প্রাপ্ত হন। তবে নির্গুণ উপাসকদের কষ্ট বেশি। কারণ নিরাকার ব্রহ্মে মনস্থির করা মানুষের পক্ষে খুবই ক্লেশকর।
তবে কি হিন্দুরা পৌত্তলিকঃ
অন্য ধর্মের লোকেরা সনাতন দর্শন সম্পর্কে না জেনেই প্রতিমা পূজা দেখে মন্তব্য করে বসেন হিন্দুরা পৌত্তলিক। কিন্তু সঠিক দর্শন জানলে তাঁদের এ ভুল ধারণা ভাঙবে। আগেই বলেছি আমাদের দেবতা অনেক কিন্তু ঈশ্বর এক। ঈশ্বরের কোনো প্রতিমা নেই। দেবতারা হলেন ঈশ্বরের এক একটি রূপের বা গুণের প্রকাশ। মূর্তি বা প্রতিমা হল সে সকল গুনের প্রতীক, চিহ্ন বা রূপকল্প। সব ধর্মেই এমন রূপকল্প, চিহ্ন বা প্রতীক আছে যা তাঁদের কাছে পবিত্র। যেমন ধরুন, খৃস্টানদের গির্জায় মাতা মেরী বা ক্রুশবিদ্ধ যীশুর প্রতিমা থাকে যার সামনে তাঁরা নতজানু হয়ে প্রার্থনা করে। আবার ধরুন, মুসলিমরা কাবা শরীফকে পবিত্র মনে করে চুম্বন করে কিংবা কোনো কাগজে আরবিতে আল্লাহ লেখা থাকলে তাকে সম্মান দেয়, তাকে যেখানে সেখানে ফেলে দেয় না। তাহলে ঐ কাগজখানা কি আল্লাহ নিজে ? না । কিন্তু তারপরও তাকে সম্মান করে কারণ তা আল্লাহর নাম ? ওটা দেখে আল্লাহর কথা মনে আসে, তার প্রতি ভালবাসা প্রকাশ পায়। আবার কেউ কেউ শূন্যপানে চেয়ে প্রার্থনা করেন। তাহলে কি ঐ শূন্যপানে ঈশ্বরের বসতি। আসলে তা নয়। কিন্তু আমরা তো এভাবে প্রার্থনা করি। এভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় জগতের সবাই পৌত্তলিক।
এ প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের একটি ঘটনার কথা বললে আমরা বুঝতে পারব। পরিব্রাজক স্বামী বিবেকানন্দ তখন আলোয়ারের মহারাজের অতিথি। আলোয়ার রাজ কথাপ্রসঙ্গে স্বামীজিকে জানালেন যে মূর্তি পূজায় তিনি বিশ্বাস করেন না । স্বামীজি একথা শুনে মহারাজার একটি চিত্র আনতে বললেন এবং রাজার দেওয়ানকে বললেন ওই ছবির উপর থুথু ফেলতে ।
সমস্ত রাজসভা নিঃশব্দে এই দৃশ্য দেখতে লাগল । দেওয়ান স্বামীজির নির্দেশ পালনে অসমর্থ হলেন, তখন স্বামীজি বললেন, ‘এই ছবি তো একটি রং করা কাগজ মাত্র, এই ছবি তো আর রাজা নয়, তাহলে এর উপর থুথু ফেলতে অসুবিধা কোথায় ? ’
স্বামীজির বারংবার নির্দেশ সত্ত্বেও দেওয়ান যখন রাজার ছবিতে থুথু ফেলতে পারলেন না তখন স্বামীজি রাজাকে বুঝিয়ে বললেন, “ফটোগ্রাফ তো একটি জড়বস্তু, একখ- রং করা কাগজ মাত্র । তবু ওই ছবিটি আসল মানুষটিকে মনে করিয়ে দেয়। ছবিটির দিকে দেখলে আমরা ভাবিনা যে নিছক কোনো রং করা কাগজ দেখছি । ঠিক তেমনই আমরা যখন মাটির মূর্তি পূজা করি আমরা মনে করি স্বয়ং ভগবানকেই পূজা করছি । আমরা সে সময় কখনো মনে করিনা আমরা কোনো জড় মূর্তি বা খড় বা মাটির উপাসনা করছি ।”
আমরা দেবতার মূর্তিকে শুধুমাত্র প্রতীক মনে করি এর বেশি কিছু নয়। এজন্য পূজার সময় পূজারী ব্রাহ্মণগণ মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন অর্থাৎ ধরে নেয়া হয় দেবতাগণ ঐ প্রতিমায় ভাস্বর হয়ে উঠবেন। আবার কাঠমাটির প্রতিমা যে ঐ সকল দেবতা নয় তার প্রমাণ মেলে পূজার পর প্রতিমাগুলোকে জলে বিসর্জন দিয়ে, যদি প্রতিমাকেই ঐ সকল দেবতা মনে করা হত তাহলে নিশ্চয় কেউ তা জলে বিসর্জন দিত না । তাই হিন্দুর দেবমূর্তি পুতুল নয়। তা চিন্ময় ভগবানেরই প্রতীক। সনাতন ধর্মে ঈশ্বরের নিরাকার ও সাকার উভয় রূপের উপাসনার বিধান আছে। যারা ঈশ্বরের অব্যক্ত বা নিরাকার উপাসনা করেন তাঁদের বলে নিরাকারবাদী। আর যারা ঈশ্বরের সাকার রূপের উপাসনা করেন তাঁরা সাকারবাদী। এজন্য স্বামী বিবেকানন্দের বলেছেন, ‘পুতুল পূজা করে না হিন্দু/ কাঠ মাটি দিয়ে গড়া। মৃন্ময়ী মাঝে চিন্ময়ী হেরে, হয়ে যাই আত্মহারা।’
আমরা নিরাকার ঈশ্বরের পূজা না করে সাকার ঈশ্বরের পূজা করি ?
জাগতিক মোহ থেকে সাকার পূজা করা হয়ে থাকে। আগেই বলেছি যে বিদ্যা চায় সে সরস্বতী দেবীর প্রার্থনা করে, যে অর্থ চায় সে লক্ষ্মী দেবীর প্রার্থনা করে, তেমনি যে বিভিন্ন বাধা বিপত্তি থেকে উদ্ধার চায় সে দূর্গা পূজা করে। এজন্য গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেন, “জড় বাসনার দ্বারা যাদের জ্ঞান অপহৃত হয়েছে তাঁরাই অন্য দেবদেবীর পূজা করেন এবং স্বীয় স্বভাব অনুসারে নিয়ম পালন করে দেবতাদের উপাসনা করেন”।
দেবতার রূপ ও গুণ মানুষের বিচিত্র রুচিকে তৃপ্ত করে ও চঞ্চল মনকে অচঞ্চল করতে সহায়তা করে। আমাদের মন যে চঞ্চল তার উদাহরণ মন্দির বা উপাসনালয়ে গেলে মনে পবিত্রতা আসে, মন প্রশান্ত হয়, মনে ভক্তি জেগে ওঠে। অথচ ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান। তাহলে কেন শুধুমাত্র মন্দিরে গেলেই মনে বেশি ভক্তিভাব আসে ? আসলে জাগতিক মোহে আবদ্ধ হয়ে আমরা ঈশ্বরের এই সর্ববিরাজমানতা ভুলে যাই ।
আর যারা সবখানে ঈশ্বরের এই অস্তিত্ব অনুভব করতে পারেন তারাই নিরাকার উপাসনার যোগ্য । তেমনি একটি ছোট বাচ্চাকে কিংবা কোনো অজ্ঞ ব্যক্তিকে যখন নিরাকার ঈশ্বর সম্পর্কে ধারণা দিবেন সে বুঝবে না বরং সে সহজে বুঝবে সাকার দেবতারূপ ঈশ্বরকে। এই সাকার রূপের প্রতিমা দেখে সহজেই বুঝতে শিখবে ঈশ্বরের গুনের কথা, শক্তির স্বরূপ সম্পর্কে । এভাবে শুরুতে সাকার উপাসনার মধ্য দিয়েই নিরাকার উপাসনার যোগ্যতা অর্জন হয় আমাদের।
তবে সব কিছুই যেহেতু সেই অসীমেরই অংশ তাই শ্রদ্ধা সহকারে দেবতার পূজাও পরোক্ষভাবে ঈশ্বরের উপাসনা। এজন্য সনাতন সংস্কৃতিতে দেখা যায় শুধুমাত্র দেবতা নয় উদ্ভিদ, উপকারী প্রাণি এমনকি মনুষ্য পূজাও করে থাকেন অনেকে। তবে দেবোপাসনায় কাম্য বস্তু লাভ হলেও ঈশ্বর লাভ হয় না। শুধুমাত্র পরম ঈশ্বরের উপাসনাতেই ঈশ্বর লাভ হয়। এজন্য গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেন, ‘যন্তি মদযাজীনহপি মাম ’ (গীতা-৯/২৫) অর্থাৎ একমাত্র আমার ভক্তগণই আমাকে প্রাপ্ত হন।
প্রতিমা বা ভগবত বিগ্রহ প্রতীক বটে তবে প্রতিমা পূজা সম্পর্কে এটাই শেষ কথা নয়। সাধনা যাত্রার প্রারম্ভে শ্রীমূর্তি হতে পারে কিন্তু সাধনার পরিনতিতে উহা চিন্ময় সত্তা। প্রতীক রুপটি চিন্ময় রুপে পরিনতি হলেই পূজা সার্থক হয়। যিনি একদিন ছিলেন অপরিচিত লোক – তারই সঙ্গে বহু মেলামেশার পর যেমন তিনি হয়ে ওঠেন পরম বন্ধু – সেইরুপ প্রতীক রূপে যে মূর্তির হয় প্রতিষ্ঠা, ভক্তের অর্চনার ফলে তিনিই হয়ে ওঠেন সাক্ষাৎ ভগবান, আচার্য রামানুজের কথায় ‘অরচ্চাবতার’।
আচার্য রামানুজের কাছে একদিন এক মূর্তি বা প্রতিমা পূজায় আস্থাহীন ব্যক্তি এসে উপস্থিত হন। তিনি আচার্যকে জিজ্ঞেস করেন, ব্রহ্ম বিশ্বব্যাপী, তাকে পূজা করার জন্য আপনি ছোট ছোট কতগুলি পিতলের মূর্তি রেখেছেন কেন ? আচার্য বললেন, আমার ধুনি জ্বালাবার জন্য আগুনের দরকার, আপনি গ্রাম হতে আমাকে আগুন এনে দিন, তারপর আপনার প্রশ্নের জবাব দিবো ।
ঐ লোকটি একখানা কাঠে আগুন নিয়ে উপস্থিত হলেন। আচার্য তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এক খ- দগ্ধ কাঠ এনেছেন কেন ? যা বলেছি তাই আনুন। আগুন বলেছি আগুন আনুন। আগুন সকল বস্তুর মধ্যেই আছে। আপনার হাত ঘষে দেখুন, হাতের মধ্যেও আগুন আছে। আপনি আমার জন্য একটু খাটি আগুন আনুন। পোড়া কাষ্ঠ চাই না।
আচার্যের কথা শুনে লোকটি বললেন, অগ্নি সব বস্তুর মধ্যেই আছে কিন্তু আপনার নিকট আনতে হলে কাষ্ঠ ছাড়া উপায় দেখি না। তখন আচার্য বললেন, সকল বস্তুর মধ্যে নিহিত অগ্নিকে আমার নিকট আনতে হলে কাষ্ঠ ছাড়া উপায় দেখেন না- আমিও সেই রূপ সর্বভুতস্থ সর্বব্যাপী পরম ব্রহ্মকে আমার নিকটতম আনতে চাইলে মূর্তিকে আরোপ ছাড়া উপায় দেখি না। আপনার হাতের কাষ্ঠ খানা আগে ছিল কাষ্ঠ কিন্তু তাতে অগ্নি ধরাবার পর তা হয়ে উঠেছে অগ্নি, তেমনি আমার নিকটস্থ এই ঠাকুরটি এক সময় ছিলেন পিতল নির্মিত মূর্তি এখন সেটি চিন্ময় ব্রহ্ম। ইহা সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ। নারায়ণ যেমন অযোধ্যায় এসেছিলেন রাম রূপে, তিনি আজ আমার দুয়ারে এসেছেন অর্চ্চাবতার রূপে। আচার্যের উক্তিটি জিজ্ঞাসু ব্যক্তিটির সকল সংশয় দূর করে দিল।
সনাতন দর্শনেই সাকার ও নিরাকার উভয় ধরনের উপাসনার মাধ্যমে ঈশ্বর পূজিত হন আর এভাবে জগতের সকল মত আর পথকে সনাতন দর্শন তার অংশ করে নিয়েছে; বলেছে সব পথেরই শেষ এক ঠিকানায়। লেখক : সহপতি, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ,নবাবগঞ্জ থানা।
