
শ্রীমদ্ভগবদগীতার আত্মতত্ত্ব শিক্ষা
আশালতা বৈদ্য
প্রথমেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে তিরস্কার করলেন কিন্তু তিরস্কারে অর্জুনের মোহভঙ্গ হল না। তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাপন্ন হয়ে বললেন – আমার চিত্ত স্বধর্ম বিষয়ে বিমূঢ় হয়েছে। আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করছি, আমার পক্ষে যা মঙ্গলকর তা নিশ্চয়পূর্বক বল। আমি তোমার শিষ্য, আমি তোমার শরণাগত, আমাকে উপদেশ দাও।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন অর্জুনকে আত্মতত্ত্বের শিক্ষা দিলেন। বললেন – যাদের জন্য শোক করা উচিত নয় তাদের জন্য তুমি কেন শোক করছ। পূর্বে আমি কখনও ছিলাম না এমন নয়, তুমি কখনও ছিলে না এমনও নয়। এই দেহধারণের পূর্বে আমরা সকলেই নিত্য আত্মরূপে বিদ্যমান ছিলাম। এই দেহ ত্যাগের পরও আমরা থাকব না এমন নয়। বর্তমানে আমরা যেমন নিত্য আত্মরূপে বিদ্যমান আছি, দেহান্তেও নিত্য আত্মরূপে বিরাজমান থাকব। মৃত্যু দৈহিক বিকার মাত্র।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আত্মা বা ব্রহ্মের স্বরূপ বর্ণনা করলেন – যিনি এই জগৎ পরিব্যাপ্ত করে আছেন তিনিই অবিনাশী আত্মা বা ব্রহ্ম। কেহই এই অব্যয় আত্মার বিনাশ করতে সমর্থ হয় না। আত্মা জন্ম-মৃত্যু রহিত, অপক্ষয়হীন এবং বুদ্ধিশুন্য। এই দেহ নষ্ট হলেও আত্মা বিনষ্ট হয় না। মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে সেইরূপ আত্মা জীর্ণ দেহ পরিত্যাগ করে নতুন দেহ গ্রহণ করে। কোনো অস্ত্র এই আত্মাকে ছেদন করতে পারে না, অগ্নি একে দগ্ধ করতে পারে না, জল একে আদ্র করতে পারে না এবং বায়ু একে শুষ্ক করতে পারে না। আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য, অশোষ্য, নিত্য, সর্বব্যাপী, স্থির, অচল ও সনাতন। আত্মা অব্যক্ত, অচিন্ত্য ও অবিকারী।
তিনি আরও বললেন – জাত ব্যক্তির মৃত্যু নিশ্চিত এবং স্বীয় কর্ম অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির পুনর্জন্ম অবশ্যম্ভাবী।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে স্বধর্ম সম্পর্কে শিক্ষা দিলেন। বললেন – স্বধর্ম অনুযায়ী তোমার ভীত হওয়া উচিত নয়। তুমি ক্ষত্রিয়, ধর্ম যুদ্ধ করাই তোমার স্বধর্ম। সুখ-অনুরাগ, দুঃখ-দ্বেষ না করে লাভ-ক্ষতি, জয়-পরাজয় সমতুল্য জ্ঞান করে ধর্মযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।
এরপর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে নিষ্কাম কর্মযোগ সম্পর্কে শিক্ষা দিলেন। বললেন – নিষ্কাম কর্মযোগের অনুষ্ঠানেই জন্ম-মৃত্যুরূপ সংসারের মহাভয় হতে পরিত্রাণ লাভ করে মোক্ষলাভ হয়। এই নিষ্কাম কর্মযোগে নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি একনিষ্ঠ হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে উপদেশ দিলেন – তুমি নিষ্কাম হও এবং ভগবানের জন্য কাজ কর। তিনি অর্জুনকে বললেন –
কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।
মা কর্মফলহেতুর্ভূমা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি।। (২:৪৭)
অর্থাৎ কর্মে তোমার অধিকার, কর্মফলে নয়। অতএব, কর্ম কর, কর্মফলে যেন তোমার কখনও আসক্তি না হয়।
স্থিতপ্রজ্ঞ সম্পর্কে অর্জুনের প্রশ্নের উত্তরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন – হে পার্থ, যখন কেহ সমস্ত মনোগত কামনা সম্পূর্ণরূপে বর্জন করে আপনাতেই আপনি তুষ্ট থাকেন, তখনই তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ হন। তিনি আরও বলেন- যিনি দুঃখে উদ্বেগহীন, সুখে নিঃস্পৃহ এবং আসক্তিশূন্য, যাঁর ভয় ও ক্রোধ নিবৃত্ত হয়েছে, যিনি সকল বস্তু ও ব্যক্তিতে স্নেহবর্জিত এবং প্রিয় ও অপ্রিয় বিষয়েও যিনি আনন্দিত বা দুঃখিত হন না তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ। ইনি ইন্দ্রিয়সমূহকে সংযত করে সমাহিত আত্ম্স্থ অবস্থায় অবস্থান করেন, কেননা যাঁর ইন্দ্রিয় সকল বশীভূত হয়েছে তাঁরই প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অর্থাৎ তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন যিনি নিঃশেষরূপে সমস্ত বাসনা পরিত্যাগ করেন, শরীর ধারণার্থ প্রয়োজনীয় বিষয়েও মমত্ব-ভাব বর্জিত ও বিদ্যাবত্তাদি অহংকাররহিত হন এবং শরীরে ও জীবনে স্পৃহাশূন্য এবং জীবনধারণ মাত্র চেষ্টাযুক্ত হয়ে পর্যটন করেন, তিনি সকল সংসার দুঃখের নিবৃত্তিরূপ পরম শান্তি অর্থাৎ ব্রহ্মনির্বাণ লাভ করেন অর্থাৎ ব্রহ্মস্বরূপে সুপ্রতিষ্ঠিত হন। এই অবস্থাই ব্রাহ্মীস্থিতি। এই অবস্থা লাভ করলে আর কেহ মোহগ্রস্ত হয় না। তিনি ব্রহ্মনির্বাণ প্রাপ্ত হন। লেখক : সম্মানিত ট্রাস্টি হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট
