ফেলে আসা রাজনৈতিক জীবনের আনন্দ-বেদনা
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতির শুন্য পদে মনোনয়ন এর প্রশ্নে বিএনপিতে দ্বিধা বিভক্তি দেখা দেয়। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এর নেতৃত্বে এক অংশের দাবি, যেহেতু গঠনতন্ত্রে এ বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা নেই, তাই বিশেষ কাউন্সিল ডাকা হোক। শাহ্ আজিজের নেতৃত্বাধীন এক অংশ চায় ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি বয়োঃবৃদ্ধ সাত্তার কে রাষ্ট্রপতি মনোনয়ন দিতে। বঙ্গভবনে সভা ডেকে শাহ আজিজ প্রতিবাদের মুখে পেশি শক্তি প্রদর্শন করে হট্টগোলের মাঝে বৃদ্ধ সাত্তারের নাম রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা করেন। এতে সংবিধান পরিবর্তন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজ সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিলে ভোটাভুটির সময় ব্যারিস্টার মওদুদ এর নেতৃত্বে ৭০/৮০ জন সংসদ সদস্য সংসদে অনুপস্থিত থাকে। পর পর তিন দিন ধরে অচল অবস্থা চলার পর সমঝোতার মাধ্যমে সকল সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে সংবিধানের ৬ষ্ঠ সংশোধন বিল পাশ করে বিচারপতি সাত্তারকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী করা হয়। বিপরীতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী করে ড. কামাল হোসেনকে। শুরু হয় সারা দেশে প্রচার প্রচারণা, সভা সমাবেশ।
নোয়াখালীর চৌমুহনীতে বিচারপতি সাত্তারের জনসভায় যোগ দিতে কয়েক জন সঙ্গীসহ আমি তথায় গমন করি। সভামঞ্চে ব্যারিস্টার মওদুদকে উঠতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও বর্তমান বিএনপির তৎকালীন যুব নেতা মোহাম্মদ শাহাজাহানসহ কয়েকজনের দৃঢ়তায় সভামঞ্চে উঠলেও তাকে বক্তৃতা করতে দেওয়া হয়নি। বি চৌধুরী ও ব্যারিস্টার হাসানাত বক্তব্য রাখেন। সভা শেষে ব্যারিস্টার মওদুদ আমাকে বলেন, তিনি বিচারপতি সাত্তারকে সমর্থন করলেও কোথাও বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না, এমন কি তার নিজের জেলায়ও নয়। আমি তখন চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক। আমি বললাম, মওদুদ ভাই আমি যদি চট্টগ্রামে কোনো সভার আয়োজন করি, আপনি যাবেন? তিনি বললেন, অবশ্যই যাব। আমি একটি তারিখ নির্ধারণ করে চট্টগ্রাম চলে এলাম। এসে নেতাদের সাথে আলাপ করলাম। কারো সমর্থন পেলাম না বরং সবাই এর তীব্রতর বিরোধীতা করলেন। আমি কারো কোনো তোয়াক্কা না করে মুসলিম হল ভাড়া করে প্রচারের জন্য মাইক নামিয়ে দিলাম রাজপথে। তখন উপ-প্রধানমন্ত্রী জামালউদ্দিন ও ডেপুটি স্পিকার ব্যারিস্টার সুলতানের বিরোধ মহা তুঙ্গে। জামালউদ্দিন ঘোষণা দিলেন মিটিং প্রতিহত করবেন। শাহ আজিজ ফোন করে ব্যারিস্টার সুলতানকে বললেন মিটিং বন্ধ করার জন্য। আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, যে কোনো মূল্যে সভা করবই করব। সব ছাত্র, বিশেষ করে শ্রমিক নেতারা আমার পিছনে ঐক্যবদ্ধ।
যথাসময়ে ব্যারিস্টার মওদুদ চট্টগ্রাম এলেন। দুপুরে স্টিল মিল এলাকায় প্রয়াত শ্রমিক নেতা কাসেম ভাই এর বাসায় দুপুরের খাবার খেয়ে তিনি যখন মুসলিম হলে এলেন, তখন হল কানায় কানায় পুর্ণ, হলের বাইরে হাজার হাজার মানুষ। আমাকে অবাক করে সলিমুল্লাহ ভাই, জাহাঙ্গীর ভাই, একরাম ভাই, আকবর ভাইসহ প্রায় সব নেতা সভায় চলে এলেন। আমার চোখে তখন বিজয়ের আনন্দ অশ্রু। আহাম্মদ নজীর এমপি চমৎকার বক্তব্য দিলেন। হলে তখন তিল ধরার স্থান নেই। মওদুদ ভাই বক্তব্য দেওয়ার আগে পলিটেকনিক কলেজ থেকে ছাত্রনেতা সরওয়ার বিশাল এক মিছিল নিয়ে সোজা সভামঞ্চে । এক পর্যায়ে মওদুদ ভাই ও সলিমুল্লাহ ভাই এর চেয়ার রেখে আর সব চেয়ার টেবিল সভামঞ্চ থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো। সভামঞ্চে তখন শতশত ছাত্র জনতা। মুর্হমুর্হ শ্লোগান এর মাঝে মওদুদ ভাই বক্তৃতা করলেন। সভা শেষে তিনি আমাকে বারবার ধন্যবাদ দিলেন। আমাকে বুকে জড়িয়ে রাখলেন দীর্ঘক্ষণ। মওদুদ ভাই জীবনে বহু মিটিং এ বক্তৃতা করছেন। আমার বিশ্বাস, সে দিনের সে বৈরী পরিবেশে এত বিশাল ও স্বতঃস্ফূর্ত সভার কথা তার স্মৃতির মানসপটে নিশ্চয় চির অমলিন হয়ে আছে।
পরিচিতি : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, এলডিপি/ ফেসবুক থেকে