
অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান
কামরুল আহসান : অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান (৯৮০-১০৫৩) বৌদ্ধ পন্ডিত, ধর্মগুরু ও দার্শনিক। দশম-একাদশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি পন্ডিত দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে এক রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা কল্যাণশ্রী এবং মাতা প্রভাবতী দেবী। তাঁর বাল্যনাম ছিল চন্দ্রগর্ভ। মায়ের নিকট এবং স্থানীয় বজ্রাসন বিহারে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি বিখ্যাত বৌদ্ধ গুরু জেতারির নিকট বৌদ্ধধর্ম ও শাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। এ সময় তিনি সংসারের প্রতি বিরাগবশত গার্হস্থ্যজীবন ত্যাগ করে ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের সঙ্কল্প করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি পশ্চিম ভারতের কৃষ্ণগিরি বিহারে গিয়ে রাহুল গুপ্তের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং বৌদ্ধশাস্ত্রের আধ্যাত্মিক গুহ্যবিদ্যায় শিক্ষালাভ করে ‘গুহ্যজ্ঞানবজ্র’ উপাধিতে ভূষিত হন। মগধের ওদন্তপুরী বিহারে মহাসাংঘিক আচার্য শীলরক্ষিতের নিকট দীক্ষা গ্রহণের পর তাঁর নতুন নামকরণ হয় ‘দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান’। একত্রিশ বছর বয়সে তিনি আচার্য ধর্মরক্ষিত কর্তৃক সর্বশ্রেষ্ঠ ভিক্ষুদের শ্রেণিভুক্ত হন। পরে দীপঙ্কর মগধের তৎকালীন শ্রেষ্ঠ আচার্যদের নিকট কিছুকাল শিক্ষালাভ করে শূন্য থেকে জগতের উৎপত্তি এ তত্ত্ব (শূন্যবাদ) প্রচার করেন। ১২ বছর বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যায়ন করে গভীর পা-িত্য অর্জন শেষে ৪৪ বছর বয়সে তিনি ভারতবর্ষে প্রত্যাবর্তন করেন।
এর পর ১৫ বছর তিনি ভারতের ওদন্তপুরী, সোমপুরী এবং বিশেষ করে বিক্রমশীল বিহারে অধ্যাপনা ও পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিব্বতের রাজার আমন্ত্রণে ও একান্ত আগ্রহে ৫৮ বছর বয়সে বিক্রমশীল বিহার থেকে তিনি তিব্বতে যান। সেখানে মহাযান বৌদ্ধধর্ম প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেন। দুই শতাধিক গ্রন্থ রচনা, অনুবাদ ও সম্পাদনা করে তিনি বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিব্বতবাসীরা শ্রেষ্ঠ গুরু হিসাবে গৌতম বুদ্ধের পরেই তাঁকে সম্মান ও পূজা করেন। সেখানে তাঁকে ‘জোবো ছেনপো’ বা মহাপ্রভূরূপে মান্য করা হয়। বাংলাদেশে তিনি অতীত বাংলার একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসাবে খ্যাত। তিনি তিব্বতের ধর্ম, ইতিহাস, রাজকাহিনী, জীবনীগ্রন্থ, স্তোত্রনামা ও সর্বোপরি ‘তাঞ্জুর’ নামে বিশাল শাস্ত্রগ্রস্থ সষ্কলন করেন। অতীত তিব্বতের কোনো । আলোচনাই তাঁকে ছাড়া সম্ভব নয়। তিব্বতের লামারা এখনো সেখানকার রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় ক্ষমতার প্রায় একচ্ছত্র অধিপতি। এই লামারা নিজেদেরকে অতীরে শিষ্য ও উত্তরাধিকারী বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। বর্তমানে ত্বিবত চীনের অধীন হলেও অতীশ দীপষ্কর শ্রীজ্ঞানের প্রভাব এখনো সেখানকার ধর্ম- সংস্কৃতিতে বিদ্যমান। অতীশের রচনা, যা তাঁর মাতৃভাষা বাংলা কিংবা সংস্কৃত ভাষায় ছিল, তার সবই এখন অবলুপ্ত। কিন্তুু তাঁর প্রায় সব গ্রন্থের অনুবাদ আজও তিব্বতে রক্ষিত আছে। তিব্বতী মহাগ্রন্থ ‘তাঞ্জুরে’ সংরক্ষিত আছে দীপষ্কর শ্রীজ্ঞানের নিজের করা ৭৯টি গ্রন্থের তিব্বতী অনুবাদ। এছাড়া তাঞ্জুরে রক্ষিত তাঁর সেসব গ্রন্থের অনুবাদকর্মে তিনি অংশগ্রহণ করেন নি তার সংখ্যা ৩৮টি। ১৩ বছর তিব্বতে বাস করে ৭২ বছর বয়সে অর্থাৎ ১০৫৪ খ্রিষ্টাব্দে লাসার কাছে ঞেথাং বিহারে প-িত, ধর্মগুরু, কবি, দার্শনিক, চিকিৎসক, পরিকল্পনাবিদ অতীশ দীপষ্কর শ্রীজ্ঞান পরলোকগমন করেন। ১৯৭৮ সালের ২৮শে জুন প-িত দীপষ্কর শ্রীজ্ঞানের পবিত্র দেহভস্থ চীন থেকে ঢাকার ধর্মরাজিক বৌদ্ধ বিহারে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আনয়ন ও সংরক্ষণ করা হয়। ঢাকার অদূরে বিক্রমপুরে অতীশ দীপষ্করের জন্মস্থান এখনো ‘নাস্তিক প-িতের ভিটা’ নামে পরিচিত। অতীশ দীপঙ্করের নামে ঢাকায় একটি বেসরকারি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আছে।
