অর্থনীতিবিদদের অভিমত সিপিডির বক্তব্যে ব্যাংকিং খাতের সঠিক চিত্র উঠে এসেছে
জাফর আহমদ : সিপিডির বক্তব্যে ব্যাংকিং খাতের সঠিক চিত্র উঠে এসেছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেন, ব্যাংকিং খাতে সমস্যা আছে বলেই রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোতে ‘ক্যাপিটাল বা মূলধন’ পুরণের জন্য প্রতিবছর বাজেট থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা দেওয়া হচ্ছে এবং ব্যাংকগুলোতে একের পর এক পর্যবেক্ষক বসাতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। সিপিডি’র বক্তব্যের পর অর্থমন্ত্রীর ‘রাবিশ’ বলে দেওয়া প্রতিক্রিয়াও সঠিক না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। গতকাল এই প্রতিবেদকের কাছে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় তারা এ কথা বলেন।
সাবেক তত্তাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোর সমস্যা পুরনো। সম্প্রতি সরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও সমস্যা হচ্ছে। ফারমার্স ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংকে সমস্যা হয়েছে। এবি ব্যাংকের মানিলন্ডারিং নিয়ে সমস্যা মামলা হচ্ছে। সিপিডির বক্তব্য নিয়ে ব্যাংকিং খাতের বক্তব্য সঠিক বলে প্রতি বছর বাজেট থেকে ব্যাংকের জন্য টাকা রাখা হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ প্রকট আকার ধারণ করেছে। বর্তমানে খেলাপি ঋণ ৮২ হাজার কোটি টাকা। সেই সাথে আছে অবলোপনকৃত আরও ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এটা ছিল ২০১৭ সালের চিত্র। আগের বছর খেলাপি ছিল ৬২ হাজার কোটি টাকা। তারপরও যদি উনি (অর্থমন্ত্রী) বলেন ব্যাংকিং খাতের কোন সমস্যা নেই তাহলে কিছু বলার নেই। সিপিডি যা বলছে তা তারা নতুন করে আবিস্কার করে নি। ব্যাংকিং খাতে যা ঘটছে তাই বলেছে সিপিডি। তিনি বলেন, গতবছর ব্যাংকিং খাতে সুশাসন পরিপন্থি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকের মেয়াদ ৮ বছর করা হয়েছে। আগে ছিল ৬ বছর। পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবারের ২ জনের পরিবর্তে চারজন করা হয়েছে। নিরপেক্ষ সদস্য নিরপেক্ষ লোককে রাখা হতো।
সিপিডির বক্তব্য সঠিক বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতের অবস্থা খারাপ থেকে খারাপতর অবস্থার দিকে গেছে-এটা সবাই জানে। সিপিডির বক্তব্য এর ভিন্ন দেখছি না। ব্যাংকিং খাতের সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। তবে অন্য যে সব কথা বলছে তা নিয়ে ভিন্ন মত আছে। দুরাবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া প্রয়োজন বলেও স্বীকার করেন সাবেক এই গর্ভনর। এই দুরাবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে সদিচ্ছার সাথে ব্যাংক কোম্পানি আইনের পরিপালন ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রবর্তন করার জন্য তিনি পরামর্শ দেন।
ব্যাংকিং খাতের দুরাবস্থা নিয়ে আগে থেকেই বলছি বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তিনি বলেন, ২০১৭ সালে যা ভয়ঙ্কর বলছি তা আরও আগে শুরু। ৪/৫ বছর আগে যে সব দূর্বল ঋণ দেওয়া হয়েছিল ২০১৭ সালে এগুলো খারাপ আকার ধারণ করে। জনগণের করের টাকায় ব্যাংকের প্রভিশন রাখা হচ্ছে আর গোপন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এগুলো না ঢেকে কঠোর তদন্ত প্রয়োজন। এর মাধ্যমে যারা দুর্নীতি করে এই ঋণ নিয়েছে এবং যারা ব্যাংকের ভেতর থেকে সহযোগিতা করছে তাদের নাম বের হয়ে আসে।
গত শনিবার ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০১৭-২০১৮: প্রথম অন্তর্র্বতীকালীন পর্যালোচনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরে সিপিডি। সংস্থাটির মতে, ২০১৭ সাল ব্যাংকিং খাতের কেলেঙ্কারির বছর ছিল। ব্যাংকের মালিকানায় এক ধরনের ‘ক্রনিজম’ (অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব) তৈরি হয়েছে। সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য অভিযোগ করেন, ব্যক্তি খাতের ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে। সঞ্চিতির ঘাটতি বেড়েছে এবং ব্যাংকে অপরিশোধিত ঋণ বেড়েছে। একই সঙ্গে জনগণের করের টাকায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংকগুলোতে মূলধন ঘাটতি পূরণ করা হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৭ এই সময়ে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণে খরচ হয়েছে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা, যা মোট পদ্মা সেতুর ব্যয়ের অর্ধেক।
সিপিডির এই বক্তব্যকে ‘রাবিশ’ বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেন, ‘সিপিডি বাংলাদেশকে নিচে নামানোর চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ এতো ভালো কাজ করছে কিন্তু সেগুলো সিপিডি প্রকাশ করে না। সংস্থাটির এ রিপোর্ট ‘অল আর রাবিশ’।