সেতুর সুপারিশ জনস্বার্থে না লুটপাটের?
সম্প্রতি ঢাকার প্রথম সারীর জাতীয় দৈনিকে এসেছে, টাঙ্গাইলের বাসাইলে প্রায় ৫৪ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত সেতু উদ্বোধনের আগেই হেলে পড়েছে। এছাড়া এলজিইডির প্রাথমিক মূল্যায়নে চিহ্নিত হয়েছে- এমপিদের সুপারিশের অর্ধেক সেতুই অপ্রয়োজনীয়। রাজধানীসহ সারা দেশে ব্যাপক খোড়া, ভাঙাচোরা, বিধ্বস্ত রাস্তাঘাট থাকার পরও এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় সেতু-কালভার্টের নামে সরকারি সম্পদ তছরুপের খবর জনগণকে দেখতে হয়। এ ছাড়াও বিস্তির্ণ ফসলের মাঠের মধ্যে অথবা লোকালয়বিহীন বিরাণ ভূমিতে, যেখানে কৃষক ও কৃষিশ্রমিকরা মাঠে যাওয়া আসা করেন জমির আইল দিয়ে, প্রয়োজন নেই কোন রাস্তা বা সেতুর, তবুও সেখানেই নির্মাণ করা হয় সেতু কোথাও কালভার্ট। রাস্তা, সংযোগ সড়ক ও প্রয়োজন ছাড়া অর্থহীন, অপ্রয়োজনীয় এসব সেতু, কালভার্ট নির্মাণ করায় জনগণ ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করে এর নাম দিয়েছে ‘ভূতের সেতু’ ।
ইতোপূর্বে একই দিনেই ঐ পত্রিকার খবর ছিলোÑ ‘সোনাইমুড়ীর বজরা ব্রিজ এখন মরণফাঁদ’, বেতাগীতে ‘অ্যাপ্রোচ সড়ক না থাকায় ব্রিজ কোনো কাজে আসছে না’, ফরিদগঞ্জে ‘সেতু আছে সড়ক নেই’, তানোরে ‘অযথাই সেতু-কালভার্ট নির্মাণ’। বর্তমানে দেশে কি চলছে পত্রিকার রিপোর্টেই উঠে আসছে।
গ্রামীণ জনপদের জনগুরুত্বের বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে হাটবাজার, সামাজিক, অর্থনৈতিক কিংবা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানসহ স্কুল, কলেজ ও হাসপাতালে যাওয়ার পথে সেতু নির্মাণকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এসব সেতু নির্মাণে প্রধানত স্থানীয় এমপির সুপারিশই গ্রহণ করে থাকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। সম্প্রতি ২ হাজার সেতু নির্মাণের সুপারিশ করেন এমপিরা। কিন্তু প্রাথমিক মূল্যায়নে এসব সুপারিশের প্রায় অর্ধেক সেতুই অপ্রয়োজনীয় বলে চিহ্নিত করেছে এলজিইডি। কোনো কোনো এমপি আবার বলে থাকেন, আমার সুপারিশ যে অপ্রয়োজনীয়, তা এলজিইডি কর্তৃপক্ষ আমাকে জানায়নি। নিজ নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা সুপারিশের আগে এমপিরা কি জানেন না? এলজিইডির মূল্যায়নে জনপ্রতিনিধিদের জনবিচ্ছিন্ন থাকার কথাই প্রমাণ হয়েছে। অথবা সেতুর সুপারিশ জনস্বার্থে নয়, লুটপাটের জন্য করা হয়েছে! এলজিইডির প্রাথমিক মূল্যায়নে দেখা গেছে, আশপাশে কোনো হাটবাজার, স্কুল-কলেজ বা হাসপাতাল নেই, এমন স্থানে সেতু নির্মাণের যেমন সুপারিশ এসেছে, তেমনি পাশে একটি সেতু থাকার পরও আরেকটি সেতু চেয়ে সুপারিশও করেছেন অনেক এমপি। কখনো কখনো শুধু বিশেষ কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি স্বার্থসংশ্লিষ্ট উদ্দেশ্যেও সেতু চাওয়া হচ্ছে। একজন জনপ্রতিনিধি একই এলাকার জন্য একাধিক অপ্রয়োজনীয় সেতু চেয়েছেন এমন নজিরও আছে। এসব সেতু নির্মাণে শুধু সরকারি অর্থ অপচয়ই শেষ তা নয়। এতে জনগণের ভোগান্তিও বাড়বে বলে মনে করছেন এলজিইডি সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এসব সেতুর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপরও। বাধাগ্রস্ত হবে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ, পানিপ্রবাহ বন্ধে নষ্ট হবে আবাদি কৃষি জমি। কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই না করে ও নকশায় সংযোগ সড়কের স্থান না রেখেই কেবলমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় নেতার ইচ্ছেপূরণ করতে কোটি টাকা ব্যয়ে সেতু-কালভার্ট নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে। যে পরিমাণ টাকা দিয়ে অহেতুক সেতু নির্মাণ করা হয়, তা দিয়ে এলাকার ভাঙা রাস্তা মেরামত করলে মানুষ বছরব্যাপী দুর্ভোগ থেকেও রক্ষা পেত। শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে লুটপাটের জন্যই এ ধরনের প্রকল্প ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করে। বিভিন্ন দেশে ও বিশ্বব্যাংকের সূদভিত্তিক এসব অর্থায়নের সুষ্ঠু ব্যবহার না হওয়ায় এর দায়ভার জনগণের উপর বর্তায়। আমাদের দেশের প্রতিটি শিশু আজ জন্মই হচ্ছে ঋণের দায়ভার নিয়ে।
বাঁধ, ব্রিজ, কালভার্টের কাজ বাস্তবায়নের জন্য কার্যাদেশপ্রাপ্ত অধিকাংশ ঠিকাদার নিজেরা কাজ না করে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেসব রাজনৈতিক স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছে সাব-কন্ট্রাক্টে বিক্রি করে দেয়। আর সাব-কন্ট্রাক্টররাও ক্ষমতার জোর ও জবাবদিহীতার কোন বালাই না থাকায় দায়সারাভাবে নিন্মমানের সামগ্রী ব্যবহার করছে। নির্মাণ কাজে কালর্ভাটের ড্রইং পরিবর্তন, উচ্চতা কমিয়ে ফেলা, গাইডওয়াল না দেওয়া, নিন্মমানের রড ও পাথর ব্যবহার, নিয়মানুসারে সিসি ঢালাই না করাসহ শিডিউলমতে পাইলিং না করে নির্মাণ কাজ করার কারণেই ধসে পড়ার ঘটনা ঘটছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
সম্পাদনা : গাজী খায়রুল আলম