ঢাবি উপাচার্যকে উদ্ধারে শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের হামলা
ইসমাঈল হুসাইন ইমু ও জোবায়ের সানি : প্রক্টরের অপসারণসহ চার দফা দাবিতে গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামানকে তার কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে ‘নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দের’ ব্যানারে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত উপাচার্য কার্যালয়ের ৩টি ফটক ভেঙে বেলা দেড়টার দিকে উপাচার্যের দরজার সামনের করিডোরে অবস্থান নেন তারা। পরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। বিকাল ৫টার দিকে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও ক্যাম্পাসে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। সংঘর্ষ চলাকালে সাংবাদিক, সাধারণ শিক্ষার্থী ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীসহ প্রায় অর্ধশত আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, গত সপ্তাহ থেকে আন্দোলন চালিয়ে আসা শিক্ষার্থীরা গতকাল সাড়ে ১১টার দিকে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে জড়ো হয়ে মিছিল শুরু করে। পরে মিছিলটি টিএসসি, কলাভবন, বিজনেস ফ্যাকাল্টি, বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ ঘুরে উপাচার্য কার্যালয়ের সামনে যায়। সেখানে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকা শিক্ষার্থীরা একসময় উপাচার্য কার্যালয়ের প্রধান ফটক ধরে ধাক্কা দিতে থাকে। এক পর্যায়ে বেলা ১২টার দিকে উপাচার্য কার্যালয়ে প্রধান ফটকের দুটি তালা ভেঙে তারা কার্যালয় প্রাঙ্গণে ঢুকে যায়। বেলা ১টার দিকে উপাচার্য কার্যালয় ভবনের কলাপসিবল গেটও ভেঙে ফেলে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। পরে বেলা দেড়টার দিকে ভবনের ভেতরের আরেকটি গেইট ভেঙে উপাচার্যের কক্ষের সামনে অবস্থান নেন।
বিকেল পৌনে ৪টার দিকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাইফুল ইসলাম সোহাগ, সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আবিদ আল হাসানসহ ছাত্রলীগের ২০/২৫ জন নেতাকর্মী ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ সেøাগান দিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন। তারা উপাচার্যকে মুক্ত করে ফের তার কার্যালয়ে নিয়ে যান। এ সময় উপাচার্যের কক্ষের সামনের করিডোরে অবস্থান নেয়া আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের রড নিয়ে তাড়া করে কয়েকজনকে মারধরও করেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এরপর কিছুক্ষণের জন্য অবরোধকারীদের উপাচার্যের দরজা সামনে রেখে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা সরে যায়। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে আবার বিভিন্ন হল থেকে বিপুল সংখ্যক ছাত্রলীগ নেতাকর্মী এসে লোহার রড ও লাঠিশোটা নিয়ে আন্দোলনকারীদের অবস্থানে হামলা চালায়। ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দীকে বেধড়ক মারধর করা হয়। এছাড়া আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র মাহাদী, ছাত্র ফেডারেশন বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি উম্মে হাবিবা বেনজির এবং সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের প্রগতি বর্মনও মারধরের শিকার হন।
সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগ নেতারা বলেন, ভিসি স্যারকে মুক্ত করতে তারা এসেছেন। কোনো হামলার উদ্দেশ্যে নয়। এই হামলাকে ‘জঙ্গি স্টাইলে’ হামলা উল্লেখ করে তারা এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে আরেকটি আন্দোলন গড়ে তোলার কথা জানান ।
রাজধানীর সরকারি ৭ কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী ব্যানারে গত ১৫ জানুয়ারির আন্দোলন কর্মসূচিতে ছাত্রীদের ওপর ছাত্রলীগের ‘নিপীড়নের’ প্রতিবাদে আন্দোলনে নামে নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষার্থীরা। নিপীড়নে জড়িত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বহিষ্কারের দাবিতে গত ১৭ জানুয়ারি প্রক্টর কার্যালয়ও ঘেরাও করে তারা। এছাড়া ছাত্র প্রতিনিধিদের নিয়ে শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে হামলার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দুদিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার দাবিও রয়েছে শিক্ষার্থীদের।
তবে প্রক্টর কার্যালয় ঘেরাওয়ের সময় ফটক ভাঙচুরের ঘটনায় ১৮ জানুয়ারি অজ্ঞাত ৫০ শিক্ষার্থীকে আসামি করে মামলা দায়ের করে প্রশাসন। এর প্রতিবাদে সেদিন মধ্যরাতে প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করে বিক্ষোভ মিছিল করে শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীরা জানান, ১৫ তারিখের নিপীড়নের ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বহিষ্কারের যে দাবি, সেই দাবি জানাতে আমরা প্রক্টর অফিসে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রক্টর ব্যর্থ হয়ে উপাচার্যের কাছে নিয়ে আসে। উপাচার্যের কাছে যে আলটিমেটাম দিয়েছিলাম তা বাস্তবায়ন হয়নি, বরং অজ্ঞাতনামা ৫০ জন শিক্ষার্থীর ওপর মামলা করেছে। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারসহ সরকারি ৭ কলেজের অধিভুক্তি সমস্যাও সুষ্ঠু সমাধান দাবি করেন তারা।
এদিকে নিপীড়নের অভিযোগের তদন্ত নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, ঘটনা তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে তাতে সাক্ষ্য দিতে ৩ শিক্ষার্থীকে ডেকেছিল কিন্তু তারা আসেননি।
রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ জিনাত হুদাকে আহ্বায়ক করে তৈরি তিন সদস্যের ওই তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে রয়েছেন সহকারী প্রক্টর আবু হোসেন মো. আহসান এবং সদস্য চন্দ্রনাথ পোদ্দার।
কমিটির সদস্য সচিব আবু হোসেন মো. আহসান বলেন, আমরা আবু রায়হান খান, উম্মে হাবিবা বেনজির ও আশিক নামে ৩ জন শিক্ষার্থীকে তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে ডেকেছি। সোমবার ফোন দেওয়ার পর সকালে চিঠিও পাঠানো হয়েছিল কিন্তু ওরা আসেনি। শিক্ষার্থীদের দেওয়া লিখিত অভিযোগে নাম দেয়া হয়নি, শুধু ৩ জন প্রতিনিধির নাম দিয়েছে। তাই আমরা তাদের বক্তব্যের জন্য ডেকেছি। সম্পাদনা : হাসিবুল ফারুক চেšধুরী