বিদ্যা-বুদ্ধি সৃজনীপ্রতিভা চারুকলা বিজ্ঞান তথা প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতির দেবী সরস্বতী। বেদ আর সরস্বতী অভিন্ন। বেদ-বেদাঙ্গ-বিদ্যার প্রসূতি সরস্বতী। ভূঃ ভুবঃ স্বঃ এই ত্রিলোক জুড়ে জ্ঞানময়ী রূপে তিনি সর্বত্রব্যাপিনী। এই বিশ্বভুবন প্রকাশিত হয়েছে তার শুক্লজ্যোতিতে। তাই সরস্বতীর বিশেষ অর্থ- জোতির্ময়ী। তিনি তিমির বিনাশী; তমসো মা জোতির্গময়ো। আবার রূপে লক্ষ্মী হলেও গুণে সরস্বতী।
দেবী সত্ত্বগুণের প্রতীক। তাই তিনি শ্বেতবর্ণা, শ্বেতবস্ত্র পরিহিতা। বীণা ও পুস্তকধারিণী মহাশ্বেতা। বৈদিক জনগোষ্ঠী ভরতদের আরাধ্য বলেই তার আরেক নাম ভারতী। অন্যদিকে বেদ বিশেষ করে সামবেদ তো সঙ্গীতরসে সিক্ত সূক্তাবলী। যজ্ঞস্থলে সারস্বত বীণাধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠত প্রতিটি স্তোত্র। আবার কেউ কেউ বলেন গন্ধর্ব কিন্নরদের সঙ্গে দেবী সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলেই সরস্বতীর অপর নাম বীণাপাণি।
বৈদিক সরস্বতী অভিন্ন হয়ে ওঠেন পৌরাণিক বাগদেবী বরদা বাগেশ্বরীর সঙ্গে। কালক্রমে সরস্বতী হয়ে ওঠেন ভাষার দেবী। বাক্য দিয়ে সজ্জিত হয়ে ওঠে ভাষা। সরস্বতী তাই বাক্যদেবী। এই কারণে বলা হয়েছে- ‘বাক হি সরস্বতী’। আজও তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাণীসরস্বরতী রূপেই আরাধিত।
শুধু হিন্দুধর্মের নন, বৌদ্ধ জৈন পরিম-লে এক জনপ্রিয় দেবী। হিন্দু জনজাতির এক একটি কুলের কুলদেবী রয়েছেন। সরস্বতী হলেন বাংলার আদি বুদ্ধিজীবী কায়স্থকুলের কুলদেবী। তবে সরস্বতী গঙ্গা যমুনার মতো প্রথমে ছিল এক নিছক নদীর নাম। সপ্তসিন্ধুর অন্যতম সরস্বতী নদী। শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ হল যাতে সরস অর্থাৎ জল আছে। তবে সরোবর নয়, প্রবহমানা নদী।
দুই তীরে গড়ে উঠেছিল লতাকুঞ্জে ঘেরা সারস্বত তপোবন। ঋষিরা সেখানে বেদপাঠ করতেন। সূচনা ও সমাপ্তিতে করতেন সরস্বতীনদীর বন্দনা। রচনা করতেন বৈদিক সূক্ত। মহাজাগতিক ভাবরসে পুষ্ট মন্ত্রগাথা। কালক্রমে নদী হয়ে গেলেন বিদ্যার দেবী। বেদের দেবী। একসময় অভিনয়ের দেবী হিসাবেও সরস্বতী পুজিত হতেন। বাৎসায়নের কামশাস্ত্র থেকে জানা যায় তৎকালীন রঙ্গমঞ্চের সাধারণ নাম ছিল সারস্বতভবন।
তবে লুপ্ত হয়ে গেলেও ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে আজও তার নাড়ির টান অটুট। লোকবিশ্বাসে গঙ্গা ও যমুনার সঙ্গে সরস্বতী যুক্তবেণী রচনা করেছে এলাহাবাদের প্রয়াগে। মুক্তি ঘটেছে হুগলি জেলার ত্রিবেণীতে। সরস্বতী নাম নিয়ে আদিসপ্তগ্রাম অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। গবেষকরা মনে করেন, বর্তমান সরস্বতীর খাতেই প্রবাহিত হত প্রাচীন ভাগীরথী। সরস্বতী নদীর তীরে ত্রিবেণী মগড়া আদিসপ্তগ্রামে সরস্বতী পুজোর ব্যাপকতা কি এই কারণে?