
স্বামী বিবেকানন্দের ভাবনায় নারী
ধীরেন্দ্র নাথ বারুরী
স্বামী বিবেকানন্দ ভারতীয় ভাবধারা ও আদর্শের এক মূর্ত প্রতীক। মানবতাবাদ তার জীবনের মূল মন্ত্র। সামাজিকভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গেলে নারী ও পুরুষকে সমানভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, এই শাশ্বত সত্যটি তিনি সম্যকভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ভারতের অধঃপতনের মূল কারণ হলো, মহিলাদের প্রতি যোগ্য সম্মান না দেওয়া। তিনি এক্ষেত্রে মনুসংহিতার একটি উক্তি উদ্ধৃত করেন যাতে মনু বলেছেন, যেখানে মহিলাগণকে সম্মানিত করা হয়, দেবতাগণ আনন্দিত হন। যেখানে মহিলারা সম্মানিত না হন, সেখানে একটি অধঃপতিত অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। স্বামীজি নারীকে শক্তিময়ী মনে করতেন। এদেশে নারীকে অবহেলা করা হয় কিন্তু আমেরিকাতে স্বামীজি লক্ষ্য করেন নারীদের অনেক সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া হয়, তাই আমেরিকা সমুন্নত সমাজের পত্তন করেছে।
ভারতীয় সমাজে মেয়েদের পুরুষের হাতে ক্রীড়নক হিসাবে ব্যবহার করা হয়। বাড়িতে ও পরিবারে এই মূল্যবোধের নিরিখে পুরুষ ও নারী বেড়ে ওঠে। স্বামীজি এই ব্যবস্থাটি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছিলেন। বিবেকানন্দ বলেছিলেন কেন এদেশে পুরুষ ও মেয়েদের এত বৈষম্য বজায় রাখা হয়? বেদান্ত বলছে উভয়ের মধ্যে তো একই আত্মা বিদ্যমান। তোমরা নারীদের সমালোচনা করো, কিন্তু তাদের জন্য তোমরা কী করেছ? প্রাচীন ভারতের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছিলেন এদেশে মহিলাদের অনেক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা আছে। মেয়েরা রাষ্ট্র চালাতে পারে, নেত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে, যুদ্ধ করতে পারে, সব কিছুতেই সে পুরুষের সমান দক্ষ। যখনই সুযোগ পেয়েছে নারীরা পুরুষের সমান দক্ষতা দেখিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্র শাসনে মেয়েরা পুরুষদের চেয়ে বেশি দক্ষতা দেখিয়েছে। মহিলাদের নৈতিকতা অনেক বেশি। এটা তাদের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য। তাই তারা পুরুষদের মতো নীচে নামতে পারে না এটা ছিল স্বামীজির বিশ্বাস। একজন বৈদান্তিক সন্ন্যাসী যার আজীবন লক্ষ্য চরম সত্য উপলব্ধি করা, তিনি নারী ও পুরুষের কোনো ভেদাভেদ মানতেন না। নারীদের তিনি শক্তির চরম প্রকাশ বলে মনে করতেন। পুরোহিতরা সমাজের মাথার উপরে বসে অন্য বর্ণের লোকেদের জ্ঞান চর্চা থেকে বঞ্চিত করেছিল। সামাজিক অবক্ষয়ের যুগে তখন নারীদেরও জ্ঞানচর্চা থেকে দূরে রাখা হয়, অথচ এই ভারতেই গার্গী, মৈত্রেয়ীর মতো বিদুষী নারীর আবির্ভাব ঘটেছে।
স্বামীজি চাইতেন মেয়েদেরও এমন জায়গায় বসাতে হবে যাতে তারা তাদের সমস্যার সমাধান করতে পারে। কারণ, জগতের উন্নতি মেয়েদের প্রগতির ওপর নির্ভর করে। তার রচনায় স্বামীজি একটি সুন্দর কথা বলেছিলেন, ‘পুরুষ ও নারী দুজনেই সমান তাদের মতো করে। পুরুষরা কি নারীদের মতো সন্তান বড় করতে পারবে? একজন কাজ করার ক্ষমতা অর্জন করেছে আর একজন কষ্ট করার ক্ষমতা অর্জন করেছে। সমগ্র বিশ্ব একটি সুন্দর ভারসাম্যের উপর দাঁড়িয়ে থাকে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে।’ স্বামীজি মনে করতেন মেয়েদের শিক্ষা দিতে হবে, আগামী প্রজন্মের মেয়েদের আরও স্বাধীনতা দিতে হবে। কারণ, প্রকৃত নারীত্ব ও তার বিকাশ হল প্রকৃত স্বাধীনতার ওপর নির্ভরশীল।
স্বামীজির মতে শিক্ষাই হচ্ছে নারী প্রগতির প্রথম সোপান। পুত্র ও কন্যা তিনি উভয়কেই কয়েক বছর ব্রহ্মচর্য পালনের পরে বিবাহের কথা বলেছেন। তিনি কন্যা সন্তানকে পুত্র সন্তানের মতোই সমান গুরুত্বের সঙ্গে বড় করতে আহ্বান জানান। তিনি বাল্যবিবাহের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। তার মতে বাল্যবিবাহই দেশে এত সংখ্যক বিধবা থাকার কারণ। আর মায়ের অল্প বয়সে যে সন্তান জন্মলাভ করে সে শারীরিকভাবে দুর্বল হবেই। তাতে মায়েদের ও শিশুদের মৃত্যুহার বৃদ্ধি পেতেই থাকবে।
স্বামী বিবেকানন্দ ও তার গুরুভাইরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। ভগিনী নিবেদিতাকে এদেশে এনেছিলেন নারী জাগরণে নতুন দিগন্ত আনতে। নিবেদিতা প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়কে সোৎসাহে স্বাগত জানিয়েছেন ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।
তিনি মহিলাদের আলাদা মঠ করতে চেয়েছিলেন যেখান থেকে ব্রহ্মচারিণী ও সাধ্বীরা প্রশিক্ষিত হবে ও নবজীবন গড়তে প্রেরণা জোগাবে। তিনি মনে করতেন পুরুষ অত্যাচার করে অবদমিত করে স্ত্রীলোককে খেঁকশিয়াল বানিয়ে রেখেছে। এই দমন পীড়ন বন্ধ হলে স্ত্রীলোক হবে সিংহিনী। তিনি বলেছিলেন ভারতের সংস্কৃতির মূল কেন্দ্রে রয়েছে ‘মা’। ঈশ্বর হচ্ছেন এই জগতের মাতা। একজন মহিলা তপস্বী ঈশ্বরের সঙ্গে জগতের সৃষ্টির ঐকতান ও ছন্দ উপলব্ধি করেছিলেন এবং তা বেদে উল্লেখ করে গিয়েছেন। আত্মোপলব্ধির সাধনায় নারী ও পুরুষের সমান অধিকার। নির্ভীক স্বাবলম্বী পবিত্র নারী সুসন্তানের জন্ম দেয়। সেই সকল সন্তান দেশের সম্পদ। আজ যদি দেশের নারীরা উন্নত হয় তখনই দেশে প্রকৃত জ্ঞান, নিষ্ঠা ও সাধনার উদ্ভব হবে। নারীদের মধ্যে স্বামীজি এমন শক্তি পোষণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন যেটি হবে ‘মায়ের হৃদয় ও বীরের ইচ্ছাশক্তির’ প্রকৃত সমন্বয়। স্বামীজির চেতনালোকে নারী হল এমন একটি সত্তা যা দেশের মঙ্গলসাধনে ও পরিপূর্ণতা বিধানে পুরুষের থেকেও কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে।
