পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান
নিউটন মন্ডল : নিজের জন্য বা নিজ নিজ সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য জমি বিক্রির ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ। তবে সমাজের আর্থিকভাবে দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য নিজের সমস্ত সম্পত্তি বিক্রির ঘটনা ইতিহাসে বিরল! দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য সমস্ত পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে ট্রাস্ট গঠনের নতুন ইতিহাস রচনা করেছেন নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ-এর রেজিস্ট্রার ফাদার আদম এস, পেরেরা, সিএসসি। মাইরানু পেরেরা ট্রাস্ট- এর শিক্ষা-বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে কথাগুলো বলছিলেন নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ এর স্টুডেন্ট কাউন্সেলর ফাদার এডমন্ড ক্রুজ, সিএসসি।৩ জানুয়ারি, বুধবার সাভারস্থ ধরেন্ডা গ্রামে মাইরানু পেরেরা ট্রাস্ট- এর বার্ষিক শিক্ষা বৃত্তি প্রদান করা হয়। বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ও নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ- এর রেজিস্ট্রার ফাদার আদম এস, পেরেরা, সিএসসি, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট কাউন্সেলর ও মেইটেইনেন্স ডিরেক্টর ফাদার এডমন্ড ক্রুজ, সিএসসি, খ্রিস্ট দর্শন সেমিনারীর পরিচালক ফাদার অপুসলোমন রোজারিও, সিএসসি, ধরেন্ডা সেন্ট যোসেফ স্কুলে কলেজের অধ্যক্ষ সিস্টার মেরী নমিতা, এসএমআরএ, ট্রাস্টের সদস্য-সদস্যা, শিক্ষাবৃত্তি প্রাপ্ত শিক্ষার্থীবৃন্দ, অভিভাবকগণ এবং গ্রামের খ্রিস্টভক্তবৃন্দ।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের পড়াশুনায় মনোযোগী, তাদের সুস্বাস্থ্য কামনা ও সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করেন ফাদার আদম.এস.পেরেরা, সিএসসি। শিক্ষাবৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানের শুরুতে বক্তব্য প্রদান করেন ফাদার এডমন্ড ক্রুজ, সিএসসি।
তিনি বলেন, ‘নিজের জন্য বা নিজ নিজ সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য নিজের জমি বিক্রির ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ। তবে সমাজের দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য নিজের সমস্ত সম্পত্তি বিক্রির ঘটনা ইতিহাসে বিরল! ফাদারের এই মহান উদ্যোগের জন্য তাঁকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।’ শিক্ষাবৃত্তি প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘তোমাদের দায়িত্ব এখন বেড়ে গেল। এখন থেকে তোমাদের পড়াশোনায় আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে।’ সেন্ট যোসেফ স্কুলে কলেজের অধ্যক্ষ সিস্টার নমিতা বলেন, আমি বিশ্বাস করি এই ট্রাস্টের মাধ্যমে বৃত্তি প্রাপ্ত দরিদ্র-মেধাবী শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবার অনেক উপকৃত হয়েছে। গত বছর আমার কলেজ থেকে ৫ জন শিক্ষার্থী এই বৃত্তি পেয়েছে। এ জন্য আমি ট্রাস্টকে কলেজের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই। এই ট্রাস্টের মাধ্যমে অনেক মেধাবী ও দরিদ্র শিক্ষার্থী উপকৃত হবে সেটাই আমরা প্রত্যাশা করি। মাইরানু পেরেরা ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ফাদার আদম এস, পেরেরা ট্রাস্ট গঠনের ইতিহাস, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমাদের ঠাকুর দাদা মাইরানু পেরেরা’র জন্মসন সঠিক ভাবে জানা না গেলেও আনুমানিক ১৮৮০-৮৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তাঁর জন্ম হয়েছিল। তিনি একজন সাধু প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন খুবই কর্মঠ। প্রতিটি মুহূর্তকে তিনি কাজে লাগানোর চেষ্টা করতেন। প্রতিদিন গির্জায় খ্রিস্টযাগ এবং সন্ধ্যায় বাড়িতে প্রার্থনায় তিনি অংশগ্রহণ করতেন। আমার পুরোহিত জীবনে আসার জন্য তিনিই ছিলেন আদর্শ ও অনুপ্রেরণা। বিভিন্ন সময়ে ফাদারগণকে দেখিয়ে উৎসাহ দিয়ে আমাকে বলতেন, ‘তোরে সাব বানামু। সাব অইবি?’ ঈশ্বর ও তাঁর ইচ্ছাকে পূরণের জন্য আমি পবিত্র ক্রুশ সংঘে যাজকত্ব বরণ করেছি। মাইরানু পেরেরার স্মৃতি ও আদর্শকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এই ট্রাস্টের নামকরণ করা হয়েছে ‘মাইরানু পেরেরা ট্রাস্ট’।’ এই ট্রাস্টের যাত্রা শুরু হয়েছে ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর। এই ট্রাস্টের প্রকৃত মালিক হলো পবিত্র ক্রুশ সংঘের ফাদারগণ। ফাদার আদম এখন এই ট্রাস্টের চেয়ারম্যান। তাঁর অবর্তমানে একজন পবিত্র ক্রুশ যাজক- এর দায়িত্বে থাকবেন এবং যদি কোন কারণে কোন দিন এই ট্রাস্ট বন্ধ হয়ে যায় তবে ট্রাস্টের সকল সহায়-সম্পদ পবিত্র ক্রুশ যাজক-সংঘে চলে যাবে। মাইরানু পেরেরা ট্রাস্ট-এর একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে পিছিয়ে পড়া মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা। তিনি শিক্ষা-বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলেন, উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তোমাদেরকে দেশ ও জাতির কল্যাণে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে, লেখাপড়ায় অধিকতর মনোযোগী হতে হবে। তিনি প্রত্যাশা করেন, যারা এই ট্রাস্ট থেকে সেবা পাবে, তারাও একদিন অন্যদের জন্য কোন না কোনভাবে সেবা প্রদান করবে। তিনি বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে আরও বলেন, প্রতি ছয় মাসে যেন তারা ট্রাস্টের নিকট তাদের পরীক্ষার ফলাফল জমা দেয়।
যে সমস্ত শিক্ষার্থী ইচ্ছা ও আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অর্থাভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছে না এই ট্রাস্টের মাধ্যমে সেই সব শিক্ষার্থীর ট্রাস্টের সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করা হবে। এবছর উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক, এবং সম্মান পর্যায়ে অধ্যয়নরত ১৩জন শিক্ষার্থী এই ট্রাস্ট থেকে ১,৮০,০০০ টাকা শিক্ষাবৃত্তি পাবে। যদি কোন সহৃদয়বান ব্যক্তি এই ট্রাস্টের মাধ্যমে গরীব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের উপকার ও আর্থিক ভাবে সহযোগিতা করতে চান তাহলে সেই দানও সাদরে গ্রহণ করা হবে।
মাইরানু পেরেরা নিজে যে ত্যাগস্বীকার করেছেন তা নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি। এই ট্রাস্ট গঠনের মাধ্যমে তিনি আমাদের মাঝে আরও অনেক দিন বেঁচে থাকবেন। পূর্ব পুরুষের স্মৃতি ও আদর্শকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ট্রাস্ট গঠনের ঘটনা ইতিহাসে বিরল। নিজের সমস্ত পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য ট্রাস্ট গঠন উচ্চ শিক্ষায় মানবতার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলে মনে করছেন গ্রামের সাধারণ মানুষ। তাদের বিশ্বাস এই ট্রাস্ট থেকে বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা ভালো পড়াশোনা করে সমাজকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। ট্রাস্টের উন্নতি, সমৃদ্ধি ও ট্রাস্টের সহায়তা গ্রহণকারীদের দায়িত্ব সম্পর্কে আরও বক্তব্য প্রদান করেন ট্রাস্টের সেক্রেটারী মি. মার্টিন সিলভেস্টার পেরের, নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ- এর প্রফেসর মি. দিলীপ কুমার সরকার, ধরেন্ডা গ্রামের মি. জন ফিলিপ পেরেরা, সিস্টার মেরী শান্তা এসএমআরএ প্রমুখ। উল্লেখ্য, শিক্ষা বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন সম্রাট হিউবার্ট পেরেরা।