ভাষার ইতিহাস ও ইসলাম
ভাষা। মানুষের মনের ভাব প্রকাশের বাহন। মানুষ একে অপরের সাথে ভাব প্রকাশ করতে হলে ভাষার প্রয়োজন। ভাষা ব্যতিরেকে ভাব প্রকাশ অকল্পনীয়। চাই তা ইশারা ইঙ্গিতের মাধ্যমে হোক না কেন। কেননা, যারা বধির, বোবা তারা ইশারা ইঙ্গিতের মাধ্যমে ব্যক্ত করে তাদের মনের কথাগুলো। তবে হ্যাঁ, পৃথিবীর সকল প্রান্তে মানুষ নিজস্ব ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে ভাবের আদান-প্রদান করছে। ভাষা বিশেষজ্ঞগণের মতে, ভাষা দুই ধরণের যে কোন একটির মধ্য দিয়ে আমাদের কাছে এসেছে।
এক. হজরত আদম আলাইহিস সালাম এর মাধ্যমে। তিনিই সৃষ্টির প্রথম। তাকে মহান রাব্বুল আলামীন সবকিছু শিক্ষা দিয়েছিলেন। এমনকি ভাষাও। আল্লাহ তা’আলা কুরআনুল কারীমে বলেন, “আর আল্লাহ তা’আলা আদম (আলাইহিস সালাম) কে সমস্ত বস্তু সামগ্রীর নাম শিখালেন” (সুরা আল বাকারাঃ ৩১)। ইসলামী বিশেষজ্ঞগণের মতানুসারে, হজরত আদম আলাইহিস সালাম কে সমস্ত ভাষার মৌলিকত্ব শিক্ষা দেয়া হয়েছিল।
দুই. আবার অনেকে বলেন, হজরত আদম আলাইহিস সালাম ও হজরত হাওয়া আলাইহিস সালাম এর মাধ্যমে যখন পৃথিবীর বুকে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি হতে লাগল, তখন দল-উপদল, সম্প্রদায় হয়ে বিভিন্ন জায়গায় জনবসতি গড়ে উঠতে শুরু হতে লাগল। আর এ সকল জনগোষ্ঠী নিজেদের সুবিধার্তে নিজে নিজেরাই ভাষার আবিষ্কার করেছে। যার কারণে ধরণীর স্থানে স্থানে, দেশে দেশে সকল প্রান্তে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন ভাষা-উপভাষা।
বিশেষজ্ঞগণের মতানুযায়ী, বর্তমান সময়ে সমস্ত পৃথিবীতে প্রায় সাত হাজার ভাষায় মানুষ তার নিজের মনের ভাবগুলো প্রকাশ করছে। কেহ কেহ তার চেয়ে বেশী ভাষা আছে বলে মত প্রকাশ করেছেন। তন্মধ্যে কিছু ভাষা আছে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। যেমন, আরবী, বাংলা, ইংরেজী, উর্দু, হিন্দি, ম্যান্দেরিয়ান, স্প্যানিশ, ফ্র্যান্স, পর্তুগীজ, রাশিয়ান, চাইনিজ ইত্যাদি।
তবে সবচেয়ে কঠিন ভাষা হচ্ছে চীনের ম্যান্দেরিয়ান ও আফগানিস্তানের পশতু ভাষা। এ ভাষা সমূহের কিছু ভাষা সমূহের রয়েছে নিজস্ব বর্ণমালা, আবার কোন ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা নেই। প্রশ্ন আসতে পারে সমস্ত পৃথিবীতে মানুষ মুখ দিয়েই কথা বলে। মুখের গড়ন-আকৃতি প্রায় একই হলেও তার মুখ নিঃসৃত ভাষাগুলো কেন ভিন্ন? যদি এক ধরণের ভাষায় মানুষ কথা বলতো তাহলে সমস্যা ছিল কোথায়? তার সুস্পষ্ট জবাব রয়েছে আল্লাহর কালাম পবিত্র কুরআনুল কারীমে। আল্লাহর অমোঘ ঘোষণা, “তাঁর আরও এক নিদর্শন হচ্ছে নভোম-ল ও ভূম-লের সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে” (সুরা আর রূমঃ ২২)। এটাই আল্লাহ তায়ালার অপূর্ব নিদর্শন। মহান রাব্বুল আলামীন বান্দাদের মধ্যে ভাষার ভিন্নতার মাধ্যমে তাঁর মহান নিদর্শনের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। আমরা জাতীয়তায় বাংলাদেশি। ভাষাগতভাবে বাঙ্গালী। আমরা কথা বলি বাংলায়। এ ভাষা মায়ের ভাষা, প্রাণের ভাষা। কবি বাংলা ভাষার গানে বলেন, ‘মোদের গরব/মোদের আশা/ আ মরি বাংলা ভাষা।’
এ ভাষার তরে কতইনা রক্তে রঞ্জিত হয়েছে মাঠ-ঘাট। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে পাবার তরে বুক পেতে গুলি খেয়েছে। কিন্তু, ভাষার মানকে রেখেছে সমুন্নত। ১৩৫৯ বঙ্গাব্দের ৮ই ফাল্গুন (১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি) বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে আন্দোলনরত ছাত্র ভাইদের উপর পুলিশের নির্মম গুলিতে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার সহ অনেকেই প্রাণ দিয়েছে। সেদিন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়েছিল রাজপথ। রাজপথেই জীবন বিলিয়ে দিতে হয়েছে এই ভাষা সৈনিকদের। তাদের আতœত্যাগের মাধ্যমে বাংলা কে আমরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পেয়েছি। এজন্য ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের জনগণের জন্য গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন। এটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও সুপরিচিত। তাদের রক্তের বিনিময়ে আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাভাষা স্থান করে নিয়েছে নিজের মত করে। বাংলাদেশী জনগণের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি বিজড়িত একটি দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। তাই এই দিনকে সারা বিশ্বে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে পালন করা হচ্ছে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্যদেশ সমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে।