২৫ মার্চের আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি ছিল!
মোহাম্মদ আলী বোখারী, টরন্টো থেকে
একাত্তরের ২৫ মার্চের ভয়াল রাতে নিরস্ত্র বাঙালির উপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরুর আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। এই অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের সাতচল্লিশ বছর পরে হলেও উন্মোচিত হয়েছে। গত ১০ মার্চ দৈনিক কালের কণ্ঠের প্রথম পাতায় মুদ্রিত ‘ছাত্রনেতাদের মুক্তিযুদ্ধ’ কলামে মুজিব বাহিনীর তদানীন্তন মানিকগঞ্জ মহকুমা প্রধান ও সাবেক সাংসদ মফিজুল ইসলাম খান কামাল তার লেখনী ‘যুদ্ধ শুরু ২৫ মার্চ অথচ বাড়িভাড়া ১ ফেব্রুয়ারি!’ শিরোনামে সেকথা তুলে ধরেছেন।
সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘আগরতলার শহরতলিতে, বাড়ীর নাম শ্রীধর ভিলা, সেখানে বেশ কদিন আশ্রয় নিলাম। একদিন মালিক ভাড়া নিতে এলেন। তাঁর কাছ থেকেই শুনলাম, বাড়িটি ভাড়া নেওয়া হয়েছে ১ ফেব্রুয়ারি। শুনেই দ্বিধায় পড়ি, ঢাকায় আক্রমণ হলো ২৫ মার্চ অথচ আগরতলায় বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে, বিষয়টি কী? তা হলে যুদ্ধের প্রস্তুতি কি আগেই পুরোপুরিভাবে নেওয়া হয়েছে?’
বস্তুত, একাত্তরের ২৮ মার্চ মানিকগঞ্জ থেকে নানা উপায়ান্তরে ৫ জুন আগরতলায় পৌঁছা এবং সেখানে স্থাপিত মুজিব বাহিনীর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে ফজলুল হক মনির নির্দেশে ওই ‘শ্রীধর ভিলা’য় বিশ্রাম গ্রহণের বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক তা লিখেছেন। সেই বর্ণনার সারাংশটি হচ্ছে, ২৮ মার্চ সকালে ক্যাপ্টেন আবদুল হালিমসহ তারা মানিকগঞ্জ শহরের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। তখন সেখানে ফজলুল হক মনি ও তোফায়েল আহমেদ উপস্থিত হন। তারা নৌকায় অপেক্ষমান ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে সিরাজগঞ্জ পৌঁছার ব্যবস্থা করতে বলেন। সেটা ছাত্রলীগ নেতা কাইয়ুমদের লঞ্চে তুলে দিয়ে করা গিয়েছিল। তিনি নিজে মানিকগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনী প্রবেশের পর ১০ মে ভারতের উদ্দেশে রওয়ানা দেবার আগে কেরানীগঞ্জে দেখা পান নিঃসঙ্গ কাজী আরেফের। পথে ফরিদপুরের খলিলপুর হাটে আবুল হোসেন বেচন ও জলিল মৌলভী নামে দুই রাজাকারের হাতে ধরা পড়েন। ভাগ্যক্রমে, কাজী আরেফের পরিচিত এলাকার চেয়ারম্যানপুত্র ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ওবায়দুলের কারণে রক্ষা পেয়ে ২০ মে কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনে নামেন। সেখান থেকে কাজী আরেফের সঙ্গে থাকা নোট বইয়ে লিখিত ‘কোন নেতা কোথায় আছেন’ এমন তথ্যের ভিত্তিতে ভবানীপুরের সানি ভিলায় সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে মিলিত হন। সিরাজুল আলম খান তাদের প্যান্ট-সার্ট কেনার জন্য ২৫ রুপি দেন।
আরও লিখেন, তখনো মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয়নি। মাঝে মাঝে ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে তাজউদ্দীন আহমদের অফিসে দেখা করতে যান। এভাবেই একদিন তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘ফজলুল হক মনি তোমাকে আগরতলা যেতে বলেছেন, আমার কাছে খবর পাঠিয়েছেন’। সেভাবে ৫ জুন বিএসএফের একটি কুরিয়ার বিমানে আগরতলায় যান এবং ফজলুল হক মনির সঙ্গে দেখা করেন। তখন ফজলুল হক মনি ওই ‘শ্রীধর ভিলা’র ঠিকানা দিয়ে বলেন, ‘যাও বিশ্রাম নাও’।
মফিজুল ইসলাম খান কামাল আরও লিখেন, তিনি ছাত্র রাজনীতি ছেড়ে তখন ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হয়েছেন। তবু শেখ মনির কথানুযায়ী মুজিব বাহিনীতে যুক্ত হয়ে এলাকার পরিচিতিদের নিয়ে দেরাদুনে কালচি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণে যান। সেখানে তাদের ব্যাচে বঙ্গবন্ধুর মেজো ছেলে শেখ জামাল ও শেখ ফজলুল হক মনির ছোট ভাই শেখ মারুফ ছিলেন। তার মতে, জনগণের মাঝে স্বাধীনতার ধারণা প্রচার ও শক্ত ভিত গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে গঠিত নিউক্লিয়াসে অন্তর্ভুক্ত হন। তথাপি লিখেন, শুরুতে সরকার পদ্ধতি নিয়ে মুজিব বাহিনীর নেতাদের সঙ্গে প্রবাসী সরকারের ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। এছাড়া যুদ্ধ পদ্ধতি নিয়েও মুজিব বাহিনীর চার নেতার সঙ্গে তাজউদ্দীনের আহমদের মতভেদ ছিল। সেগুলো কিছুদিন পর কেটে যায়। ছাত্রলীগও বহুধাবিভক্ত ছিল। দেখা যায়, মুজিব বাহিনীর রাজনৈতিক প্রশিক্ষক বা মোটিভেটর হিসেবে যেসব নেতা কাজ করেছেন তাঁদের সিংহভাগ পরবর্তীকালে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে জাসদে যোগ দেন।
ই-মেইল : bukhari.toronto@gmail.com