
বঙ্গবন্ধু ও বাঙালির অসীম সাহসিকতার প্রিয় স্বাধীনতা
বঙ্গবন্ধু ছাত্রজীবন থেকেই চিন্তা করতেন কীভাবে বাঙালি জাতির ভাগ্য উন্নয়ন করা যায়। স্কুল জীবন থেকেই দেখেছেন কীভাবে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বাঙালি তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা তারা পায়নি। সোহরাওয়ার্দী সাহেব যখন বঙ্গবন্ধুর স্কুল ভিজিট করতে গিয়েছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু তখন যেসব প্রশ্ন সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে করেছিলেন তাতে দেখা যায় তার ব্যক্তিসত্বা, চিন্তা এবং আকাক্সক্ষা। বঙ্গবন্ধু যখন স্কুল জীবনের পরিসর পেরিয়ে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ গেলেন তখন তার চিন্তার জগৎ অনেক বিস্তৃত হলো। ওই সময়েই কাছে পান তার রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে। তারপর তার উত্থান শুরু হয়।
বঙ্গবন্ধু চেষ্টা করছিলেন কীভাবে বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ একটু উন্নতি করা যায়। অনেক চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা ঘোষণা করলেন। গণঅভ্যুত্থান, অতঃপর সত্তরের নির্বাচন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরুষ্কুষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। সেটি তিনি তার জীবনের স্বপ্নের একটি পথরেখা দেখতে পেলেন। সেই স্বপ্নটা কী? বাঙালি জাতির অধিকার সুরক্ষা করা। এটা আমাদের অজানা ছিল না। তখন আমি পাকিস্তান সরকারে চাকরি করি, জেনেভায়। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো ওই নির্বাচনের ফলাফল গ্রহণ করবে না। শেষ মুহূর্তে যখন মার্চে বাঙালি জাতির স্বপ্নের সফলতা কিছু দেখতে পাচ্ছিল তখন ইয়াহিয়া এবং ভুট্টো বাংলাদেশে এলেন। আলাপ-আলোচনার জন্য এলেও কার্যত তারা পাকিস্তান থেকে যত বেশি সেনা আনা যায় সেই প্রচেষ্টা চালালেন। করাচি-কলম্বো-ঢাকা, ভারতের উপর দিয়ে কোনো পাকিস্তানি ফ্লাইট আনা যাবে না। এই চলমান অবস্থায় অনেক ঘটনার মধ্যদিয়ে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান বাহিনী অপারেশন সার্চ লাইটের মাধ্যমে হত্যাযজ্ঞ শুরু করল, যা পৃথিবীর ইতিহাসে একটি জঘন্যতম কালো অধ্যায়ের সূচনা করল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, যারা মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর দর্শনে বিশ্বাসী তাদেরকে একে একে নৃশংসভাবে হত্যা করল। ইতোপূর্বেই ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো এশিয়া-আফ্রিকা দখল করেছিল। এবং শাসন করেছিল। তারা যুদ্ধ ও ধীরে ধীরে আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা পেয়েছিল। কিন্তু নৃশংস হত্যাকা- কোথাও ঘটেনি। এর মধ্যে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলে বঙ্গবন্ধু। তার যে স্বপ্ন ছিল তা তিনি পূরণ করলেন। ৯ মাস যুদ্ধ, ৩০ লাখ মানুষের প্রাণ, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম, বিনিময়ে পেলাম চির আকাক্সিক্ষত স্বাধীনতা।
৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু দুটি গুরুত্বপূর্ণ বাক্য বলেছিলেন, সেই দুটি বাক্য বাঙালির জাতির পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করল। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। স্বাধীনতা অর্জনের পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু লন্ডন, দিল্লি হয়ে ফিরে এলেন প্রিয় স্বদেশে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। দেশ তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত। দেশটিকে গড়ে তোলার কাজে হাত দিলেন। যুদ্ধের সময় চাকরি ছেড়ে আমি মুজিব সরকারের পক্ষে কাজ শুরু করলাম। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ের প্রয়াস চালানো শুরু হলো। ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্য হলাম আমরা। একই বছর ২৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন জাতিসংঘের সদর দপ্তর নিউয়র্কে, ভাষণটি দিলেন বাংলায়। তিনি বাংলাদেশকে জাতিসংঘের মাধ্যমে পৃথিবীর কাছে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ। বাংলাদেশ রাষ্ট্র সাংবিধানিকভাবে অসাম্প্রদায়িক। যেখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খিষ্ট্রান, মুসলিম, নৃ-জাতিগোষ্ঠী সবারই সমান অধিকার।
স্বাধীনতার ৪৬ বছর পার করছি আমরা। এর মধ্যে অনেক অর্জন আমাদের আছে। প্রায় ক্ষেত্রেই আমাদের অর্জন বিস্ময় জাগানিয়া। বিশ্ব অন্তত সেটা স্বীকার করে। তারা বিস্মিত আমাদের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে। আমাদের বিস্ময় জাগানিয়া উন্নয়নের স্বীকৃতিও জোটেছে সম্প্রতি। জাতিসংঘ বলেছে, উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার যেসব শর্ত পূরণ করা দরকার তার সব সূচকই অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এই উন্নয়ন ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে চূড়ান্ত স্বীকৃতিও মিলবে বাংলাদেশের। আশা করছি যত বাধা-বিপত্তি, প্রতিকূলতা রয়েছে সব কাটিয়ে এগিয়ে যাবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত
