
শরিয়তের মানদ-ে ‘শবে বরাত’
হাবিব মাসউদ
১৪ শা’বান দিবাগত রাতটি হচ্ছে পবিত্র শবে বরাত বা বরাতের রাত্র। কিন্তু অনেকে বলে থাকে কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ এর কোথাও শবে বরাত বলে কোনো শব্দ নেই। শবে বরাত বিরোধীদের এরূপ মূর্খতাপূর্ণ বক্তব্যের জবাবে বলতে হয় যে, শবে বরাত শব্দ দু’টি যেরূপ কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ এর কোথাও নেই তদ্রƒপ নামায, রোযা, খোদা, ফেরেশতা, পীর ইত্যাদি শব্দ কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ এর কোথাও নেই।
এখন শবে বরাত বিরোধী লোকেরা কি নামায, রোযা ইত্যাদি শব্দ কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ এ না থাকার কারনে ছেড়ে দিবে? খোদা, ফেরেশতা ইত্যাদি শব্দ কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ এ না থাকার কারনে মহান আল্লাহ পাক ও ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাদের অস্বীকার করবে?
মূলত শবে বরাত, নামায, রোযা, খোদা, ফেরেশতা, পীর ইত্যাদি ফার্সী ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত। ফার্সী শব অর্থ রাত্রি এবং বরাত অর্থ ভাগ্য বা মুক্তি। সুতরাং শবে বরাত মানে হল ভাগ্য রজনী বা মুক্তির রাত। শবে বরাত এবং এর ফযীলত কুরআনের আয়াত এবং অসংখ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
কুরআন শরীফ এ শবে বরাতকে লাইলাতুম মুবারাকাহ বা বরকতময় রাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর হাদীছ শরীফ এ শবে বরাতকে লাইলাতুন নিছফি মিন শা’বান বা শা’বান মাসের মধ্য রাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি কুরআন শরীফের সূরা দুখানের ২-৫ আয়াতে ইরশাদ করেন, ‘শপথ প্রকাশ্য কিতাবের! নিশ্চয়ই আমি বরকতময় রজনীতে কুরআন নাযিল করেছি। নিশ্চয়ই আমিই সতর্ককারী। আমারই নির্দেশক্রমে উক্ত রাত্রিতে প্রতিটি প্রজ্ঞাময় বিষয়গুলো ফায়সালা হয়। আর নিশ্চয়ই আমিই প্রেরণকারী’
কেউ কেউ বলে থাকে যে, “সূরা দু’খানের উল্লেখিত আয়াত শরীফ দ্বারা শবে ক্বদর-কে বুঝানো হয়েছে। কেননা উক্ত আয়াত শরীফ এ সুস্পষ্টই উল্লেখ আছে যে, নিশ্চয়ই আমি বরকতময় রজনীতে কুরআন নাযিল করেছি। আর কুরআন শরীফ যে ক্বদরের রাতে নাযিল করা হয়েছে তা সূরা ক্বদরেও উল্লেখ আছে । এ প্রসঙ্গে মুফাসসির কুল শিরোমণি রঈসুল মুফাসসিরীন বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) তিনি স্বীয় তাফসীরে উল্লেখ করেন, ‘মহান আল্লাহ পাক তিনি লাইলাতুম মুবারাকাহ বলতে শা’বান মাসের মধ্য রাত বা শবে বরাতকে বুঝিয়েছেন।’ মহান আল্লাহ পাক তিনি এ রাতে প্রজ্ঞাময় বিষয়গুলোর ফায়সালা করে থাকেন। লাইলাতুম মুবারাকাহ দ্বারা শবে বরাতকে বুঝানো হয়েছে তার যথার্থ প্রমাণ সূরা দু’খানের ৪ নম্বর আয়াত শরীফ ‘হাকিমিন আমরিন কুল্লা ইয়ুফরাকু ফিহা’। এই আয়াত শরীফ এর ইয়ুফরাকু শব্দের অর্থ ফায়সালা করা। প্রায় সমস্ত তাফসীরে সকল মুফাসসিরীনে কিরামগণ ইয়ুফরাকু শব্দের তাফসীর করেছেন ইয়ুকতাবু অর্থাৎ লেখা হয়, ইয়ুফাছছিলু অর্থাৎ ফায়সালা করা হয়, ইয়ুতাজাও ওয়াযূ অর্থাৎ বন্টন বা নির্ধারণ করা হয়, ইয়ুবাররেমু অর্থাৎ বাজেট করা হয়, ইয়ুকদ্বিয়ু অর্থাৎ নির্দেশনা দেওয়া হয় । কাজেই ইয়ুফরাকু-র অর্থ ও তার ব্যাখার মাধ্যমে আরো স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, লাইলাতুম মুবারাকাহ দ্বারা শবে বরাত বা ভাগ্য রজনীকে বুঝানো হয়েছে। যেই রাত্রিতে সমস্ত মাখলুকাতের ভাগ্যগুলো সামনের এক বছরের জন্য লিপিবদ্ধ করা হয়, আর সেই ভাগ্যলিপি অনুসারে রমাদ্বান মাসের লাইলাতুল ক্বদর বা শবে ক্বদরে তা চালু হয়। এজন্য শবে বরাতকে লাইলাতুৎ তাজবীজ অর্থাৎ ফায়সালার রাত্র এবং শবে ক্বদরকে লাইলাতুল তানফীয অর্থাৎ নির্ধারিত ফায়সালার কার্যকরী করার রাত্র বলা হয়। (তাফসীরে মাযহারী, তাফসীরে খাযীন, তাফসীরে ইবনে কাছীর, বাগবী, কুরতুবী, রুহুল বয়ান, লুবাব)
মহান আল্লাহ পাক তিনি যে সুরা দু’খান-এ বলেছেন, আমি বরকতময় রজনীতে কুরআন শরীফ নাযিল করেছি ”এর ব্যাখ্যামূলক অর্থ হল ” আমি বরকতময় রজনীতে কুরআন শরীফ নাযিলের ফায়সালা করেছি। আর সুরা ক্বদর-এ ‘আমি ক্বদরের রজনীতে কুরআন শরীফ নাযিল করেছি’ এর ব্যাখ্যামূলক অর্থ হল, আমি ক্বদরের রজনীতে কুরআন শরীফ নাযিল করেছি’। অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক তিনি শবে বরাতে কুরআন শরীফ নাযিলের সিদ্ধান্ত নেন এবং শবে ক্বদরে তা নাযিল করেন।
এখানে শবে বরাতের (পনের শাবানের রাত) ফযীলত বিষয়ক দু’একটি হাদিস যথাযথ উদ্ধৃতি ও সনদের নির্ভরযোগ্যতার বিবরণ সহ উল্লেখ করা হল। মুআয ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী করীম স. বলেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ শবে বরাত সম্পর্কে উপরোল্লিখিত হাদীসটি সহীহ। কোন গ্রহণযোগ্য মুহাদ্দিস এটাকে দুর্বল বা জাল বলেন নি।
