একগুঁয়ে আন্দোলন মানে আপনি সমাধান চান না
শেখ মিরাজুল ইসলাম
‘দুই পা এগিয়ে প্রয়োজনে এক পা পেছানো, তারপর আবার চার পা আগানো’। সচরাচর এই ফর্মুলাতে নিহিত থাকে সফল আন্দোলনের চাবিকাঠি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তান জান্তার বিরুদ্ধে কিংবা ’৯০ এর গণআন্দোলনে খালেদা-হাসিনা এই ফর্মুলাতে সফল হয়েছিলেন। একগুঁয়ে মনোভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাবার অন্য অর্থ- আপনি সমাধান চান না। ঘটনার পেছনে যাই থাকুক সর্বমহলে এটা স্পষ্ট হয়েছে, সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি সংস্কার করা প্রয়োজন। কিন্তু তা করতে গিয়ে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের চলমান আন্দোলনের রূপরেখার সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ছে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের আনুষাঙ্গিক উদ্দেশ্যগুলো।
প্রথম কথা, অনেকগুলো ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’ জাতীয় সংশয় যদি জন্ম নেয় এই কোটা সংস্কারভিত্তিক সামঞ্জস্যপূর্ণ আন্দোলনের ডালপালা থেকে, তবে ধরে নেওয়া যেতে পারে একটি সামষ্টিক ভালো উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে চলেছে। দ্বিতীয় কথা, পরিসংখ্যান ও উপাত্ত ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০% কোটা পরিবর্তন যদি আন্দোলনের একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়, তা প্রকারান্তে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তখন বুঝে নিতে হবে এই আন্দোলনের পেছনে বড় অশুভ ইস্যু কাজ করছে। যদিও মূল আন্দোলনকারীরা এই ইস্যুটিকে অস্বীকার করে আসছেন। তৃতীয় ও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, দেশে বিরোধী দলগুলো যদি জনমত তৈরিতে নিজেদের কোনঠাসা অবস্থান থেকে পরিত্রাণ পেতে এই রকম স্বতস্ফুর্ত রেডিমেড ইস্যুকে নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডা হিসেবে দাবি করতে থাকেন, তবে ভবিষ্যতে নিরপেক্ষ অন্য কোনো ইস্যুতে গণমানুষের ন্যায্য অধিকারের গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনগুলো অঙ্কুরে বিনাশ হতে পারে। বিশেষ করে এই রাজনৈতিক অপতৎপরতায় ক্রমে চাক্ষুসমান হচ্ছে এটি অহিংস নয়, সহিংস আন্দোলন। চারুকলায় পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভা যাত্রার প্রস্তুতিমূলক শিল্পকর্ম ধ্বংস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি’র বাসভবনে ভাংচুর-অগ্নিসংযোগসহ সাংবাদিক পেটানো ঘটনাগুলো নতুন মাত্রা যুক্ত করে এই আন্দোলনের গতি ভিন্ন খাতে নিয়ে যায়। একে যারা উদ্দেশ্যমূলক বলে মতামত দিচ্ছেন তারা রাজনীতির জটিল মাঠে কতটা হালে পানি পাবেন তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ, এই জাতীয় আন্দোলন কখনো সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক হতে পারে না। যারা দাবি করছেন এটি অরাজনৈতিক, তারা পারতপক্ষে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করতে ব্যর্থ তা সমঝোতা বৈঠকের মতানৈক্য দেখে বোঝা যায়। অন্যপক্ষে কেউ রাজনৈতিক কাঠামোর আশ্রয় নিতে চাইলে সরাসরি প্রশাসনিক দমনপীড়নের মাত্রা আরও উর্ধ্বমুখী হবে বলা বাহুল্য। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কৃষিমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর সাম্প্রতিক মন্তব্য। ক্রমে আন্দোলনকে ঘিরে সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে জনমত সৃষ্টি হওয়া পারতপক্ষে দাবি-দাওয়ার গতিপ্রকৃতিও অনেক বদলে দিচ্ছে। শুধু আবেগকে সম্বল করে এগোতে চাইলে সেই পরিস্থিতি কতটুকু অনুকূলে থাকবে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। টিয়ার শেলের ঝাঁঝালো ধোঁয়ায় সবাই এর মধ্যে বুঝে গেছেন প্রশাসন আন্দোলনের নামে শৌখিনতার ধার ধারে না।
তাই শুরুতে আন্দোলনের মূল শর্ত ও দাবিনামা স্পষ্ট করে সাধারণ জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে সুদূরপ্রসারী সফলতা আশা করা যায় না। রাস্তাঘাট অবরোধ করে ক্লাস বর্জনে যারা সাময়িক সফলতা দাবি করছেন তারা যা অর্জন করবেন তা আবার হারিয়েও ফেলতে পারেন। চূড়ান্ত সফলতা পেতে সমঝোতার পথ বন্ধ করে দেওয়ার ভিন্ন বার্তা থেকে স্পষ্ট হচ্ছে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মূল ফর্মুলা থেকে বের হয়ে আসার ইঙ্গিত। নিঃসঙ্গ আমজনতা অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছেন চিত্রনাট্যের শেষ অংশটুকু দেখার জন্য।
লেখক : চিকিৎসক ও লেখক/সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ