
শবে মিরাজের ইতিহাস ও তাৎপর্য
গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির
মি’রাজ আরবি শব্দ। এর অর্থ সিঁড়ি, সোপান যা দ্বারা উর্ধ্বারোহন বা উর্ধ্বগমন। ইসলামি পরিভাষায় হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মক্কা হতে বায়তুল মোকাদ্দাসে (জেরুজালেম) উপনীত হওয়া এবং সেখান হতে সপ্তাকাশ ভ্রমণ করে মহান আল্লাহ্পাকের সান্নিধ্যে উপস্থিত হওয়ার ঘটনাকে মি’রাজ বলে। নবুয়তের দশম বর্ষের আরবি রজব মাসের ২৭ তারিখ রাতে এই অলৌকিক ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী মি’রাজ সংঘটিত হয়।
মি’রাজ পূর্ব সময়টি ছিল রাসুলে পাক (সা.)-এর জন্যে দুঃখ ও বেদনাময়। মক্কায় কাফেরদের অত্যাচার ও নিষ্ঠুরতা এতই বৃদ্ধি পেল, যার দরুন তিনি দেশ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। মক্কা হতে ৭০ মাইল দূরে তায়েফ নগরীতে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে গেলেন। তাঁর সাথে ছিল পালিত পুত্র হযরত জায়েদ (রা.)। তায়েফ গমনের পর সেখানের লোকজন রাসুল (সা.) এর সাথে যে নিষ্ঠুর আচরণ করে ছিল তা আমাদের অনেকেরই জানা। তায়েফবাসী নিষ্ঠুর অত্যাচারে রাসুল (সা.) অচেতন হয়ে পড়েন। পালিত পুত্র জায়েদ (রা.) নিজের জীবন বাজি রেখে রাসুল (দ.) কে নিয়ে তায়েফ নগরী হতে বেরিয়ে আসেন। পালিত পুত্রের সেবায় রাসুল (দ.) কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেন। রাহমাতুল্লিল আলামীনকে নির্বোধ তায়েফবাসী না চিনে তাঁকে যে কষ্ট দিয়েছিল, সে কথা স্মরণ করে আজো লক্ষ কোটি আশেকে রাসুল কান্নায় বুক ভেজায়। হযরত রাসুল (দ.)এর চরম ও দুঃসহ অসহায়ত্বের মুহূর্তে মহান আল্লাহ পাকের প্রেমের বাঁধ ভেঙে গেল। বন্ধুর কষ্টে ব্যথিত হয়ে তাকে কাছে ডেকে সান্ত¦না দেওয়া ও প্রয়োজনীয় কথা বলার জন্য এবং মহান আল্লাহ তাঁর বন্ধুকে একান্ত কাছে পাওয়ার বাসনায় উদগ্রীব হয়ে পড়লেন। হযরত জিব্রাইল (আ.) মারফত রাসুল (সা.) কে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে ডেকে নিয়ে উভয়েই একান্তে মিলিত হলেন। যা ইসলামের ইতিহাসে মি’রাজ নামে পরিচিত।
মি’রাজ সম্পর্কে কারো মতভেদ না থাকলেও তিনি জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে পরিভ্রমণ করেছিলেন কিনা সে সম্পর্কে মতভেদ দেখা যায়। অধিকাংশ হাদীস বিশারদ ও তাসাউফ বিজ্ঞানীর মতে রাসুল (সা.) জাগ্রত অবস্থায় এবং সশরীরেই মি’রাজ গমন করেছিলেন। তা না হলে বিষয়টি নিয়ে সে সময়ে মক্কাবাসীর মাঝে এত হৈ চৈ পড়ার কথা ছিল না। স্বপ্নের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের বেলায়ও অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটে থাকে। এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। রাসুল (সা.) যদি বলতেন যে, তিনি স্বপ্নে মি’রাজ গমন করেছিলেন, তাহলে এ নিয়ে আর কোন কথাই হতো না। অতএব তিনি যে জাগতিক অবস্থায় সশরীরেই আল্লাহপাকে দীদার লাভ করেছিলেন এতে সন্দেহের কোনই কারণ নেই। পবিত্র মি’রাজকালীন রাসুল (সা.) যখন তাঁর প্রভুর দীদার লাভে ধন্য হয়ে আনন্দে বিভোর ছিলেন। তখনো তিনি উম্মতে মোহাম্মদীর কথা ভুলেননি। কারণ তিনি তাঁর উম্মতগণকে সর্বাধিক ভালবাসতেন। তাঁর উম্মতগণও তাঁকে জীবনের চেয়ে অধিক ভালবাসেন। রাসুল (সা.) ভাবলেন, আমার উম্মতগণও যদি আল্লাহ পাকের দীদার লাভের সুযোগ পেতো তাহলে তারা কতই না আনন্দিত আর সৌভাগ্যবান হতো। অন্তর্যামী মহান আল্লাহ প্রিয় বন্ধুর মনের কথা জানতে পেরে বন্ধুর উদ্দেশ্যেই বললেন, হে আমার প্রিয় বন্ধু, আমার সাথে আপনার যেমন দীদার হয়েছে, তেমনি আমার সাথে আপনার উম্মতদেরও দীদার হবে সালাতের মাধ্যমে।
মহান আল্লাহ পাকের এ কথায় রাসুল (সা.) অত্যন্ত খুশি হলেন এবং পবিত্র মি’রাজ হতে ফিরে এসে তিনি ঘোষণা করলেন সালাত (নামাজ) মু’মেনদের জন্যে মি’রাজ স্বরূপ। অর্থাৎ সাধনা করে যাঁরা মু’মেনের মর্যাদায় উন্নীত হবেন নামাজের মাধ্যমে তারা মহান আল্লাহ পাকের দীদার লাভের সুযোগ পাবেন। রাসুল (সা.) আরও বলেছেন, মু’মেনের দিল (হৃদয়) আল্লাহ পাকের আরশ। অর্থাৎ যিনি মু’মেন তাঁর হৃদয়েই মহান আল্লাহ পাকের পবিত্র আসন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাঁর বন্ধুর উদ্দেশ্যে বলেন হে মুহাম্মদ (সা.) আমার বান্দাদের মধ্যে যাঁরা মু’মেন তাদেরকে বলুন সালাত (নামাজ) কায়েম করতে (১৫ঃ১৩)। রাসুল (সা.) কর্তৃক পবিত্র মি’রাজ রজনীতে প্রভুর নিকট থেকে তাঁর উম্মতের জন্য পাওয়া শ্রেষ্ঠ নেয়ামত বা উপহার হচ্ছে সালাত। এ সালাতের মাধ্যমেই উম্মতে মোহাম্মদীগণ প্রভুর দীদার লাভের সুযোগ পাবে। তবে যাঁরা মু’মেন তাদের জন্যেই শুধু এ সুযোগ উন্মুক্ত রয়েছে। তাই পবিত্র মি’রাজের উপহার সালাত কায়েমের মাধ্যমে প্রভুর দীদার লাভের চেষ্টা করা আমাদের একান্ত প্রয়োজন। আমরা যেন প্রভুর দীদার লাভে ধন্য হতে পারি। এটাই হোক আমাদের এবারের মি’রাজের প্রতিজ্ঞা। লেখক : কলামিস্ট, সাংবাদিক
