কুন্দুজে শহিদ হাফেজদের স্মরণে
মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ
চোখেমুখে রাজ্যের হাসি। মনের মাঝে আশাগুলো সুপ্ত হয়ে আছে তখন। খানিকটা বাদে মাথায় মুকুট পরানো হবে তাদের। একজন অপরজনের দিকে তাকাচ্ছে আড় চোখে চোখে। মুখে মৃদুহাসি। চোখে ইশারায় তাদের কথা হচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। সারি সারি কাতারে বসে আছে তারা। সবার হাতে সনদনামা। শিক্ষকবৃন্দ একে একে পরিয়ে দিচ্ছেন হাফেজদের সম্মানিত ও জান্নাতি মুকুট। ছেলের হাসিমুখ দেখে বাবারাও আজ মহাখুশি। সবার মাঝেই যেন স্বর্গীয় হাসি। মাথায় পাগড়ি এখন। সৌন্দর্যের এক অপূর্ব মোহনা, সুভা পাচ্ছে চারদিক। সামনের সারিতে বসে আছেন শিক্ষকগণ। তাদের দীর্ঘদিনের সাধনা আজ সফল হওয়ার পথে। তাদের খুশি যেন চোখের অশ্রু দিয়ে। প্রতিক্ষণ যারা ছাত্রের জন্য কল্যাণ কামনা করেন, তাদের চোখ এখন অশ্রুসিক্ত। তবে এ অশ্রু দুঃখের নয়, সুখের ও আনন্দের।এদিকে দুইভাই বাজার থেকে নিজেদের জন্য সম্মানী মালা কিনে মায়ের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘আম্মু আগামিকাল মাদরাসায় দস্তারবন্দি মাহফিল হবে, আমরা পাগড়ি নিয়ে ঘরে আসলে আমাদেরকে নিজ হাতে মালাগুলো পরিয়ে দিবেন। আমাদের বন্ধুরাও মালা কিনে তাদের মাকে এভাবে দিয়েছে।’ পরের দিন সকালে কলিজার টুকরাদ্বয়কে গোসল করিয়ে নতুন কাপড় পরিয়ে দিলেন। চোখে সুরমা লাগিয়ে বললেন, বাবা পাগড়িটি তো পরিধান করে নাও । কলিজার টুকরোদ্বয় উত্তরে বলল, ‘পাগড়ি তো আমাদের উস্তাদ পরাবেন।’ এ বলে দৌড়ে চলে গেলো মাদরাসা মাহফিলে। মনোরম পরিবেশ আর মহীরুহ কল্লোল পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে।
অপেক্ষমাণ মা, কখন আসবে তাদের বুকের মানিক। দীর্ঘদিনের আশা আজ পূরণ হতে যাচ্ছে, ডাকছে তাদের হাতছানি দিয়ে। হাতে মালা নিয়ে বসে আছেন। অনেকটা সময় পার হয়ে গেলো। মা বারবার দরজার দিকে আসেন আবার ফিরে যান। অপেক্ষার পালা কেনো যে শেষ হচ্ছে না। হঠাৎ বিকটাকার শব্দ। চতুর্দিক দৌড়াদৌড়ি। কেউ পানি নিয়ে কেউ আবার গাড়ি নিয়ে ধেয়ে আসছে। কী হয়েছে? আচমকা ঘাবড়ে গেলেন হাবিবুল্লাহ আর ইহসানুল্লাহর মা। দৌড়ে এলেন উঠানে। দেখলেন, কয়েকজন মিলে তাদের আদুরের দুই মানিককে নিয়ে আসছেন। চোখে অশ্রুবন্যা। মা তাৎক্ষণিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। খানিকটা পর চিৎকার। বাগশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন বোধ হয়। কাঁদতে ভুলে গিয়েছেন সে সময়টায়। কেবল আল্লাহর কাছে বললেন, ‘ইয়া আল্লাহ! তুমি আমার মানিককে ফিরিয়ে দাও। যারা আমার মানিককে কেড়ে নিয়েছে, তাদের তুমি ছাড়বে না। বিচার করবে, খুব শক্ত বিচার।’
বলছিলাম, আফগানিস্তানে কুন্দুজ শহরের কথা। একদল শিশু সুবিশাল কোরআন মুখস্থ করেছে। তাদের এ কীর্তিতে খুশি শিক্ষকরা। খুশি গর্বিত বাবা-মায়েরাও। রীতি অনুযায়ী, এ ক্ষুদে হাফেজদের মুখস্থ করার জন্য সংবর্ধনা প্রদান করা হবে। হাফেজ হওয়ার স্বীকৃতিস্বরূপ মাথায় পাগড়ি পরানো হবে। কিন্তু ১১-১২ বছরের শিশুরা কোনো সংবর্ধনা পায়নি। বরং সংবর্ধনাস্থলেই তাদের ওপর বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করা হয়েছে। আফগানিস্তানের কুন্দুজ প্রদেশের একটি মাদ্রাসায় এমন বর্বরোচিত ঘটনার জন্ম দিয়েছে মানুষখেকো কিছু অমানুষ। এতে ১০১ ক্ষুদে হাফেজ প্রাণ হারিয়েছে। তাদের মাঝে শিক্ষক ও অভিভাবকরাও রয়েছেন লাশের সারিতে।
সদ্য শহিদ হওয়া হাফেজরা এখন জান্নাতে পাখি হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের অনুষ্ঠান এখানে নয়, মহান রাব্বুল তা নির্ধারণ করে রেখেছেন জান্নাতের ফুলবাগানে । তাদের জন্য দুঃখ নয়, নয় বেদনা। তাদের জন্য হৃদয়ের সর্বোচ্চ উষ্ণতা। তারা শহিদ, তারা আল্লাহর মেহমান। তাদের মৃত বলো না। তারা মরেনি, মরেছে বিশ্বমানবতা।লেখক: শিক্ষক, বাইতুন নূর মাদ্রাসা ঢাকা।