রমজানের প্রস্তুতি কেমন হবে?
মুহিব্বুল্লাহ শহিদ
রমযান একটি মোবারক ও সম্মানিত মাস। এই মাসে একের পর এক বান্দার ওপর আল্লাহর রহমত ও বরকত নাজিল হতে থাকে। আল্লাহ তায়ালা রমযান মাসে বান্দার দোয়া কবুল করবেন বলে ওয়াদা রয়েছে হাদিসে পাকে। এটি সে মাস যে মাসে বান্দা ইচ্ছা করলে দুনিয়া আখিরাতের পুণ্য অর্জন করে কামিয়াবি ও সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে পারে।
সৌভাগ্যবান ঐ সমস্ত ব্যক্তি যারা পুনরায় রমযান মাস পাবে। এটা একদিক থেকে আল্লাহ তায়ালার কৃপা ও অনুগ্রহ। অন্যদিক থেকে পূণ্য অর্জনের সুবর্ণ সুযোগও বটে। আল্লাহ তায়ালা বান্দা কে বারবার এই সুযোগ দিয়ে থাকেন। যাতে বান্দা আল্লাহ পাকের দরবারে এসে নিজেদের গুনাহসমূহকে মাফ করিয়ে নিতে পারেন।
অন্যথায় এমন অনেক লোক রয়েছে যারা বিগত বছর আমাদের সাথেই ছিলো। কিন্তু আজ তারা এই ক্ষণস্থায়ী জিন্দেগি থেকে চিরস্থায়ী জিন্দেগির দিকে পাড়ি জমিয়েছে। এই মাস চলে যাওয়ার কারণে পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরামগন ছয় মাস পর্যন্ত সীমাহীন আফসোস করতেন। বাকি ছয় মাস আগ থেকেই এর প্রস্তুতি নিতেন। প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন মুফতি তকি উসমানি দা. বা. লিখেন, আমার সম্মানিত পিতা হযরত মুফতি মুহাম্মদ শফী সাহেব রহ. বলতেন, রমজানের আগমন ও তার প্রস্তুতি হলো, মানুষ প্রথমে এই ফিকির করবে যে, সে নিজের দৈনন্দিন কাজ তথা ব্যবসা-বাণিজ্য, চাষবাস, ডিউটি ইত্যাদি দুনিয়াবী যে কাজগুলো তার জন্য পরবর্তীতে করা সম্ভব সেগুলোকে পিছিয়ে দিবে। এবং যে সময়টা ফারেগ হবে সেসময়টা ইবাদতে ব্যয় করবে। (ইসলাহে খুতুবাত)
রমজান মাস মূলত ফজিলতের মাস। সকল মুসলমানই এর আগমন অপেক্ষায় থাকে। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) নিজেও রমজান মাস আগমনের অপেক্ষায় থাকতেন। এবং রজব মাস থেকেই অন্যান্য দোয়ার সঙ্গে এই দোয়াও বেশি বেশি পড়তেন ‘হে আল্লাহ! আমাদের জন্য রজব এবং শাবান মাসে বরকত দান করুন। এবং রমযান মাস পর্যন্ত আমাদের হায়াতকে দীর্ঘায়িত করুন।’
হাদিস থেকে এভাবে দোয়া করারও ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, হে আল্লাহ! আমাকে রমজানের জন্য সহিহ-সালেম ও সুস্থ করিয়া দিন । এবং সুস্থতার সাথে সাথে রমজানকে নাজাতের উসিলা বানিয়ে দিন।
নবী করিম (সা.) শাবান মাসে ইবাদতের গুরুত্ব অন্যান্য মাসের তুলনায় বেশি দিতেন। এবং রমযান মাসের পূর্ব প্রস্তুতি মূলক এক আমলি নমুনা পেশ করতেন। রাসুল (সা.) রমযান মাসের গুরুত্ব ও মহত্ত্বকে সামনে রেখে সাহাবায়ে কেরামদের একত্রিত করতেন এবং এর ফযিলত বর্ণনা করতেন। হযরত সালমান ফারসি (রা:) বর্ননা করেন যে, শাবানের শেষ তারিখে রাসুল (সা.) আমাদের এক খুতবা দেন। এতে তিনি বলেন, হে লোক সকল! তোমাদের সামনে এমন একটি বরকত পূর্ণ ও সম্মানিত মাস আসতেছে যার মাঝে এমন একটি রাত রয়েছে যা হাজার মাস হতেও উত্তম। অর্থাৎ শবে কদরের রাত্রি।
আল্লাহ তায়ালা রমযান মাসে রোযাকে ফরজ করেছেন। এবং তারাবিকে সুন্নত করেছেন। যে ব্যক্তি এই মোবারক মাসে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের জন্য একটি সুন্নত আদায় করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে এর বদলা অন্যান্য মাসে একটি ফরয আদায় করা সমপরিমাণ দিবেন। এবং এই মাসের একটি ফরয নেকির ছাওয়াব অন্যান্য মাসে সত্তরটি ফরয আদায় করার সমান। এই মাসে মুমিন বান্দার রিযিক বৃদ্ধি করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি এই মাসে কোনো রোজাদারকে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি ও নেকি হাসিলের উদ্দেশ্যে ইফতার করাবে, ঐ রোজাদার তার গোনাহ ও দোযখের আগুন থেকে রক্ষার জন্য মাধ্যম হবে। এবং রোজাদারের সমপরিমাণ ছাওয়াব তাকে দেওয়া হবে। এতে করে রোজাদারের ছাওয়াব থেকে বিন্দু মাত্রও কমানো হবে না।
রাসুল (সা.) কে জিজ্ঞাসা করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল (সা.) আমাদের প্রত্যেকেই ইফতার করানোর মতো সামর্থ্য রাখে না। তাহলে কি আমরা যারা সামর্থ্যবান নই তারা এই মহান ছাওয়াব থেকে বঞ্চিত থাকবো? আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন এই ছাওয়াব ঐ ব্যক্তিকেও দেয়া হবে, যে কোনো রোজাদারকে একটি খেজুর অথবা সামান্য পানি দ্বারা হলেও ইফতার করাবে।
রাসুল (সা.) বলেন, এই মোবারক মাসের প্রথম অংশ রহমত, দ্বিতীয় অংশ মাগফিরাত তৃতীয় অংশ দোযখের আগুন থেকে নাজাতের জন্য। যে ব্যক্তি এই মাসে নিজের গোলাম ও অধীনস্থদের কাজ হালকা ও কমিয়ে দিবে আল্লাহ তায়ালা তার গুনাহসমূহকে মাফ করে দিবেন এবং দোযখ থেকে মুক্তি দান করবেন।
রাসুল (সা.) বলেন এই মাসে চারটি জিনিস বেশি বেশি করা উচিৎ। প্রথম দুটি হলো বেশি বেশি কালিমায়ে তায়্যিবা ও এস্তেগফার পড়া। দ্বিতীয় দুটি হলো জান্নাতের প্রার্থনা করা ও দোযখ থেকে পানাহ চাওয়া। প্রথম দুটি দ্বারা আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন হয়। এবং বাকি দুটি এমন যে, বান্দা এর থেকে কখনো অমুখাপেক্ষি নয়।
রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারের তৃষ্ণা মিটাবে আল্লাহ তায়ালা তাকে কেয়ামতের দিন আমার হাউজে কাউসারের পানি তৃপ্তি সহকারে পান করাবেন। অতপর জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত আর পানির পিপাসা অনুভব হবে না। রমজান মাসে তাহাজ্জুদের বড় ফজিলত রয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি রমযান মাসে তাহাজ্জুদের সময় উঠে ইয়াকিন ও এখলাছের সঙ্গে নামাজ আদায় করবে। আল্লাহ তায়ালা তার পিছনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিবেন। বড়ই সৌভাগ্যবান ঐ সমস্ত ব্যক্তি যারা রাতের অন্ধকারে উঠে জিকির-আজকার, কোরআন তেলাওয়াত, দোয়া এস্তেগফার এবং আল্লাহকে স্মরণ করে।
শাইখুল হাদিস হযরত মাওলানা যাকারিয়া কান্দলবী (রহ.) লিখেন, হযরত মাওলানা শাহ আব্দুর রহিম রায়পুরী (রহ.) এর খানকাহ রমজান এলে দিন-রাত শুধু তেলাওয়াতের আওয়াজেই মুখরিত থাকতো। রমজানে ডাকের মাধ্যমে চিঠিও আসতে নিষেধ করে দিতেন। খাদেমদেরকে বলে রাখতেন, তাদের প্রয়োজনীয় কোনো কথা থাকলে তারাবির নামাজ শেষে হজরত যে সময়টাতে চা পান করেন এর ভিতরে যেনো সেরে নেয়। বাকি সময়টুকুতে সাক্ষাৎ করাও মুশকিল হয়ে যেতো।
শাইখুল হাদিস মাওলানা মাহমুদ হাসান (রহ.) সম্পর্কে বলা হয় যে, রমযান মাসে উনার বিশেষ এক অবস্থা হতো। দিন রাত শুধু আল্লাহ তায়ালার ইবাদতেই মশগুল থাকতেন। দিনের কিছু সময় শুধু বিশ্রাম নিতেন আর সারারাত কোরআন শরীফ তেলাওয়াত ও শ্রবণ করে কাটিয়ে দিতেন।
লেখক: ফাযেলে দারুল উলুম দেওবন্দ, ইউপি, ভারত।