
হিন্দু ধর্ম বিশাল এক অশ্বত্থ বৃক্ষ
ধীরেন্দ্র নাথ বারুরী
হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে কিছু ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। অনেকে মনে করে থাকেন এ ধর্ম দুর্বোধ্য ও অযৌক্তিক। এরূপ মনে করার কারণ এর বিশালত। কতগুলি বিশ্বজনীন মৌলিক সত্য রয়েছে এবং বিভিন্ন দৃষ্টি-ভঙ্গিতে নিরূপিত সে সত্যের উপর হিন্দু ধর্ম প্রতিষ্ঠিত। এ যেন বিশাল এক অশ্বত্থ বৃক্ষ! এর শাখা-প্রশাখা অসংখ্য। অনেকে এর কোনটি শাখা, কোনটি উপশাখা বুঝতে পারেন না। কাজেই যে কোনো শাখা বা উপশাখাকে ধরে হিন্দু ধর্মকে বুঝতে গিয়ে ভ্রান্ত হওয়া স্বাভাবিক। আবার এর যে কোনো শাখা বা প্রশাখা হিন্দু ধর্মের সার্বিক পরিচায়ক নয়।
আমরা জানি যে শাক্ত, শৈব, সৌর, গাণপত্য, বৈষ্ণব প্রভৃতি অনেক সম্প্রদায় রয়েছে হিন্দু ধর্মে । দ্বৈত, অদ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত কত মতবাদ; জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি, যোগ-কত মার্গ! এগুলো ধর্মের সোপান। কাজেই কোনো পথ অবলম্বন করা উচিত তা নির্ণয় করা একটু কঠিন বৈকি! কঠিন হলেও এর সমাধান আছে। বিশেষ বিবেচ্য যে, এর কোনো একটিকে বাদ দিলে হিন্দু ধর্মের সার্বিক রূপ পাওয়া যাবে না।
আসলে এসব ভিন্ন মতবাদ সকলই সমসূত্রে গাঁথা। এ সূত্রটি হলো বেদচতুষ্টয়। বেদ হিন্দুর মূল ধর্ম গ্রন্থ। এ ধর্মগ্রন্থে কি আছে, আর কি নেই সে বিষয়ে অবহিত হিন্দু ধর্ম সম্বন্ধে ধারণা করা সমীচীন। বেদ অর্থে জ্ঞান। খ্রীস্টের জন্মের বহু বছর পূর্ব এ বেদের সৃষ্টি। এর দুটি বিভাগ আছে। কর্মকা- ও জ্ঞান কা-। সংহিতা ও ব্রাহ্মণ কর্মকা-। সংহিতা এবং ব্রাহ্মণে যাগযজ্ঞাগি ক্রিয়া ও মন্ত্রাদি আছে। আরণ্যক নামে আরও অংশ আছে যাতে কর্ম ও জ্ঞান উভয়েরই কথা আছে। বেদের অন্তভাগে রয়েছে বেদান্ত- যা সমগ্র বেদের সার, জ্ঞানের বিষয়। জ্ঞানকা-ের অপর নাম উপনিষদ। গুরুর পাদপদ্মে উপবিষ্ট এ বিদ্যা আহরণ করতে হয়। সমগ্র বেদের শীর্ষস্থানীয় এ বিদ্যাকে ব্রহ্মবিদ্যা বলা হয়। যে সব মতবাদ বা ভাবাদর্শ বেদকে প্রমাণ বলে গ্রহণ করে না বা উপনিষদে সংগৃহীত বেদের সারতত্ত্বগুলিকে গ্রহণ করে না, সেসব মতবাদকে হিন্দুধর্মের অঙ্গ বলা যায় না। উপনিষদসহ শ্রুতিকে বেদ বলা হয়।
এটি কোনো ব্যক্তিবিশেষের রচিত নয়। পরমার্থ তত্ত্ব ঋষিগণের উপলব্ধ এবং গুরশিষ্যপরম্পরায় শ্রুত বলে এর নাম শ্রুতি। যুগ যুগ ধরে অতীন্দ্রিয় উপলব্ধি দ্বারা এ জ্ঞান আহরণ করা হয়েছে। সত্যদ্রষ্টা ঋষিগণের এ অতীন্দ্রিয় জ্ঞান জড় বিজ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা নিশ্চয়ীভূত হয় না। দ্রষ্টার অনুভূতি অঙ্কশাস্ত্রের মতো অভিন্ন না-ও হতে পারে। এতদসত্ত্বেও ঋষিগণের পুঞ্জীভূত অনুভূতির মধ্যে এ মৌলিক ভাবধারায় ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত। এ কারণে এদের তুরীয় দর্শনের সত্যতা প্রমাণিত। কাজেই বেদ স্বপ্রমাণ ও স্বপ্রকাশ।
হিন্দুধর্মের বিভিন্ন শাখার প্রবক্তাদের মধ্যে কিছু গৌণ অনুসিদ্ধান্ত ও আনুষঙ্গিক বিষয়ের ব্যাখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে; কিন্তু মৌলিক তত্ত্বে মতভেদ নেই। এ পার্থক্যগুলো দেখে সাধারণ মানুষ বিচলিত হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন যায়- আধ্যাত্মিক জীবনের উচ্চস্তরে আরোহন না করে এসব সূত্র তত্ত্বগুলোর বিষয়ে ব্যাখ্যার নিগুঢ়তা উপলব্ধি করা অসম্ভব নয় কি? এ বিড়ম্বনা মাত্র। কাজেই এসব বিষয়ের ভ্রান্ত ধারণা বর্জ্জনীয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আচার-ব্যবহারে কিছু কুসংস্কার রয়েছে। বহু গ্রহীষ্ণু বিজাতীয় মতবাদ এ ধর্মকে গ্রাস করবার চেষ্টা করেছে। এসবকে উপেক্ষা করেও এই ঔপনিষদিক ধর্ম মাথা উঁচু করে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে আজও। এ অবিনাশী শক্তির মূলে রয়েছে এর সার্বভৌমত্ব। হিন্দু ধর্মের সারতত্ত্ব বেদান্তে। শ্রী মদ্ভগবদগীতা বেদান্তের সার। স্বামী বিবেকানন্দ গীতাকে বেদান্তের দৈবভাষ্য বলে আখ্যা দিয়েছেন। এ ধর্মের মূল উৎসগুলিতে সাম্প্রদায়িক মতবাদের কোনো স্থান নেই। এতে আছে কিছু দেবাতাত্মা মানুষের নৈর্ব্যক্তিক পারমার্থিক অনুভূতি। সর্বস্তরের দর্শন, কবিতা ও সঙ্গীত একীভূত হয়েছে এ ধর্মে।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অসংখ্য মনীষীগণ সর্বজনীন এ ধর্মতত্ত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন গভীরভাবে। এ প্রসঙ্গে জার্মান দার্শনিক শোপেন হাওয়ারের উপলব্ধি লক্ষ্যনীয়- ‘সারা পৃথিবীতে বেদান্তের ন্যায় এত উন্নত ও মঙ্গলদায়ী পাঠ্য কিছু নেই। জীবিত অবস্থায় আমি এ সান্ত¡না পেয়েছি, মৃত্যুকালে পাব প্রশান্তি।’ সুপ-িত ম্যক্সমূলারের উপলব্ধি- ‘পৃথিবীতে যত দার্শনিক মতবাদ আছে তার মধ্যে বেদান্ত সর্বাপেক্ষা মহীয়ান এবং যত ধর্মমত আছে তার মধ্যে বেদান্ত সর্বাপেক্ষা শান্তিদায়ক।’
হিন্দু ধর্ম অবতারবাদে বিশ্বাসী। ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের আবির্ভাব হলে ধর্ম সংস্থাপনের জন্য ভগবান নরদেহে অবতীর্ণ হন। কিন্তু কোনো কোনো দেশে ধর্মীয় মহাপুরুষকে ঈশ্বরের পুত্র এবং দূত হিসেবে মনে করা হয়। এবং তৎপ্রবর্তিত বাণীই চূড়ান্ত ধর্মীয় তত্ত্ব বলে মানা হয়। যারা এটি মানতে রাজি নয়, তারা অবিশ্বাসী বলে শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। লক্ষ্যনীয়, এসব ধর্মে প্রশ্ন-মীমাংসার কোনো স্থান নেই। হিন্দু ধর্মে অবতারও কিন্তু অনন্য নন।
অধর্মের অভ্যূদয় যুগে যুগে হয় এবং প্রতিকারের জন্য ভগবানকে বিভিন্ন রূপে অবতীর্ণ হতে হয়। সব যুগের সমস্যা একরূপ থাকে না। কাজেই সমাধানের বিধানও স্থান কাল-নির্বশেষে এক হতে পারে না। তাই হিন্দুশাস্ত্র মতে অবতার একাধিক। মানুষের মধ্যেও দেবত্ব বা ভগবৎ শক্তির অভিব্যক্তি লক্ষ্য করা যায়। যেসব মানুষের মধ্যে দেবত্বের বিশেষ বিকাশ ঘটে তাকে অমূর্ত ব্রহ্মের প্রতিভূ বলা হয়, এবং তিনিই অবতার। শাস্ত্রে এর উল্লেখ আছে। এসব লক্ষণযুক্ত হলে অপর ধর্মের প্রবর্তককে অবতার বলে স্বীকার করতে দ্বিধা করি না। হিন্দুধর্মাবলম্বীগণ এভাবে শ্রী রাম, শ্রী কৃষ্ণের মত বুদ্ধকেও অবতার বলে মানে।
সেভাবে হিন্দুরা বৌদ্ধ-খ্রীস্টান না হয়েও বুদ্ধ ও খ্রীস্টের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে কুণ্ঠা বোধ করে না। এভাবে হিন্দু ধর্মে উদারতাই পরিলক্ষিত হয়। স্বামী বিবেকানন্দ বলেন- ‘ধর্ম হচ্ছে মানুষের অন্তর্নিহিত তত্ত্ব।’ ‘ব্রহ্মৈব স্যাং ব্রহ্মাপ্যোতে’ মানুষের মধ্যে এ দেবত্বের বিকাশ দেখে স্থান-কাল-জাতি-নির্বিশেষে হিন্দুরা শ্রদ্ধা জানায়। কেউ যদি একজন অবতার বা ভগবৎ প্রতিনিধির নির্দিষ্ট পথ অবলম্বন না করে অবতারের বাণী গ্রহণ করে তাহলে সে ব্যক্তি ধর্ম পতিত হবে । ঈশ্বরানুভূতি বা ব্রহ্মজ্ঞান যদি ধর্মের লক্ষ্য থাকে এবং ভগবৎ প্রেরিত নররূপী ভগবান নানা যুগে নানা পথের সন্ধান দেন, তাহলে এর যে কোনো নিষ্ঠার সাথে অবলম্বন করে চললে একই গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো যায়। শ্রী ভগবান গীতামুখে বলেছেন-
যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্।
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ। (গীতা-৪/১১)
যে যেভাবে আমার শরণাপন্ন হয় আমি তাকে সেভাবেই অনুগ্রহ করি।
এই মহাবাক্যে এক বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। এ তাৎপর্য উপলব্ধি না করে হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে বিরূপ সমালোচনা করা অর্বাচীনতা ছাড়া আর কিছুই নয়। যা-খুশি করলেই হিন্দুধর্ম- এরূপ অপব্যাখ্যা অজ্ঞতার নামান্তর। প্রপদ্যন্তে- শব্দে বলা হয়েছে- আমাতে শরণাগত হও। এটি বুঝলে ভাব পরিস্কৃত হবে। ভগবদগীতায় এরূপ অনেক শব্দের অবতারণা রয়েছে। যেমন- মামুপেত্য ৮/১৫, ব্যাপাশ্রিত্য ৯/৩২, মামাশ্রিত্য ৭/২৯। এসব শব্দ গভীর ভাববহ। নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধাসহ ভগবানের আশ্রয় গ্রহণ করলে জ্ঞান, ভক্তি, কর্ম, যোগ- যে কোন মার্গ অবলম্বন করে ভগবৎ প্রাপ্তিই ঘটে। এমন কি অন্য ধর্মও যদি ঈশ্বর সর্বশক্তিমান ও সকলের ¯্রষ্টা হন তাহলে একাধিক ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার্য নয়। আবার ঈশ্বরকে লাভ করাই যদি প্রতিটি ধর্মের উদ্দেশ্য থাকে তাহলে কোন ধর্মের প্রবক্তাই নতুন কোন ঈশ্বরের পরিকল্পনা করে প্রার্থনা করবার উপদেশ দিতে পারেন না। অন্যদিকে প্রতিটি ধর্মের অনুসারিগণ যদি উপলব্দি করেন যে অন্যান্য ধর্মমতবাদিগণও সেই একই ঈশ্বরের উপাসনা করছেন তাহলে কোনো সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি হতে পারে না, বরং ধর্ম সম্বন্ধে ভেদবুদ্ধি দূরীভূত হয়ে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের অবসান ঘটবে। লেখক : সভাপতি, সনাতন ধর্মীয় মহাম-ল।
