চড়ক পূজা
নিতাই চাঁদ তালুকদার এফ.সি.এ
চড়ক পূজা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকউৎসব। চৈত্রের শেষে পূজার শুরু, চলে দুই তিন দিন ব্যাপী। এ উৎসব শিবের গাজনের অঙ্গও। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে মেলাও বসতে দেখা যায়।
বৃহদ্ধর্মপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে চৈত্র মাসে শিব আরাধনার উল্লেখ থাকলেও চড়ক পূজার উল্লেখ নেই। পূর্ণ পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত গোবিন্দানন্দনের বর্ষক্রিয়াকৌমুদি ও রঘুনন্দনের তিথিতত্বেও এ পূজার উল্লেখ পাওয়া যায় না, তবে পশুপাত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনকাল থেকেই এ উৎসবের প্রচলন ছিল। উচ্চ স্তরের লোকদের মধ্যে এ অনুষ্ঠানের প্রচলন খুব প্রাচীন নয়। জনশ্রতি রয়েছে, ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামের এক রাজা এই পূজা প্রথম শুরু করেন।
এ পূজার অপর নাম নীল পূজা। গম্ভীরাপূজা বা শিবের গাজন এই চড়কপূজারই রকমফের। চড়ক পূজা চৈত্রসংক্রান্তিতে অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিবসে পালিত হয়।
আগের দিন চড়ক গাছটিকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয়। এতে জলভরা পাত্রে শিবের প্রতীক শিবলিঙ্গ রাখা হয়, যা পূজারিদের কাছে ‘বুড়োশিব’ নামে পরিচিত। পতিত ব্রাহ্মণ এ পূজার পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন। পূজার বিশেষ বিশেষ অঙ্গ হলো কুমিরের পূজা, জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুরির ওপর লাফানো, বাণফোঁড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, চড়কগাছে দোলা এবং দানো-বারানো বা হাজরা পূজা করা।
এই সব পূজার মূলে রয়েছে ভূতপ্রেত ও পুনর্জন্মবাদের উপর বিশ্বাস। পূজার উৎসবে বহু প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়। চড়কগাছে ভক্ত বা সন্ন্যাসীকেলোহার হুড়কা দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়। তার পিঠে, হাতে, পায়ে, জিহ্বায় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে বাণ শলাকা বিদ্ধ করা হয়। কখনো কখনো জ্বলন্ত লোহার শলাকা তার গায়ে ফুঁড়ে দেয়া হয়। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার আইন করে এ নিয়ম বন্ধ করলেও গ্রামের সাধারণ লোকের মধ্যে এখনো তা প্রচলিত আছে।
পূজার উদ্যোক্তারা কয়েকজনের দল নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। দলে থাকে একজন শিব ও দুজন সখী। একজনকে সাজানো হয় লম্বা লেজ দিয়ে, তার মাথায় থাকে উজ্জ্বল লাল রঙের ফুল। সখীদের পায়ে থাকে ঘুঙুর। তাদের সঙ্গে থাকে ঢোল-কাঁসরসহ বাদকদল। সখীরা গান ও বাজনার তালে তালে নাচে। এদেরকে দেল বা নীল পাগলের দল’ও বলা হয়। এরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাজনের গান গায় এবং নাচ-গান পরিবেশন করে। বিনিময়ে দান হিসেবে যা কিছু পাওয়া যায় তা দিয়ে হয় পূজা।
বাংলাদেশের রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, নীলফামারী, বগুড়া, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, যশোর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা প্রভৃতি জেলায় চড়ক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। স্থানগুলো একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, বাংলাদেশের যে অঞ্চলগুলো মূলত কৃষিপ্রধান সেখানেই চড়কপূজা উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বাংলার প্রাচীন কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার শরীরে প্রবেশ করতে হলে এরকম উৎসবগুলোকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করলেই কেবল লৌকিক বাংলার আদিরূপ দেখা সম্ভব হবে। লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ পূজা উদজাপন পরিষদ, নবাবগঞ্জ উপজেলা।