
দাম্পত্য সমস্যার কারণ ও ধরন
ড. ফাদার মিন্টু এল, পালমা
বিবাহ হলো একটা জটিল বাস্তবতা। তাই দাম্পত্য জীবন একেবারে সম্পূর্ণ সমস্যা ও সংকট মুক্ত নয়। দাম্পত্য জীবনের চলমান বাস্তবতায় চোরের মত যে কোন সময় ইচ্ছা-অনিচ্ছা সত্ত্বেও যে কোন সমস্যা প্রবেশ করতে পারে। সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে দাম্পত্য জীবনে দ্বন্দ একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন রূপে এর আবির্ভাব ঘটে। দাম্পত্য সমস্যার মূলত সৃষ্টি হয় দু’জনের প্রয়োজনের চাহিদা থেকে অর্থাৎ একজন প্রয়োজনের চাহিদার সাথে অন্যজনের প্রয়োজনের চাহিদার মধ্যে সংঘর্ষ।
এই লেখায় মূলত দাম্পত্য সমস্যার কারণ ও এর ধরনগুলো উল্লেখ করবো। কারণগুলো হলো বাহক অর্থাৎ যার জন্য সমস্যাগুলো দাম্পত্য জীবনে আসে। আর ধরনগুলো হলো এর হাবভাব অর্থাৎ এর রকম ও গুরুত্ব হিসাবে এর প্রভাব।
ক) সমস্যার কারণ: এটাকে আমরা সমস্যার এজেন্ট বলতে পারি। অর্থাৎ যার বা যাদের দ্বারা এই সমস্যার সৃষ্টি বা কারণ। দাম্পত্য সমস্যার পিছনে তিন রকম এজেন্ট রয়েছে। তাহলো ১। ব্যক্তি নিজে, ২। বিবাহের মূল উপাদানে এবং ৩। বাইরের বা পারিপার্শ্বিক কারণ-
১। ব্যক্তি নিজে কারণ : বিবাহ একজন পুরুষ এবং একজন নারীর দাম্পত্য বন্ধন। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে এক হলেও তারা নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ও স্বতন্ত্র জীবনবোধ নিয়ে সমৃদ্ধ। এখানে এই ব্যক্তি হিসাবে স্বামী-স্ত্রী নিজেরাই দাম্পত্য সমস্যার কারণ হতে পারে। যেমন স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক কারণ: শারীরিক দীর্ঘকালীন রোগ-ব্যাধি, অসুস্থতা, শারীরিক দুর্বলতা, শারীরিক অক্ষমতা, ছোঁয়াছে রোগ ইত্যাদি; মানসিক কারণ: মানসিক রোগ, মানসিক রিকারগ্রস্ততা, ট্রমাটিক, সাইসিক, নিয়োরটিক সিজোফ্রেনিক, এ্যালকোহলিক, মানসিক ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি। ব্যক্তিত্ব: অন্তর্মুখী যেমন ঘরকোনা, চাপা স্বভাব, হীনমন্য, সন্দেহবাতিক, সংকীর্ণচেতা নিঃসঙ্গ ও নিয়ন্ত্রণহীন আবেগ; আবার অন্যদিকে বর্হিমুখী যেমন অতিরিক্ত হৈহুল-র স্বভাব, সময় জ্ঞানের অভাব, বাইরে বাইরে সময় কাটানো, বন্ধু সার্কেল নিয়ে আড্ডা মারা, দায়িত্বজ্ঞানহীন ইত্যাদি। এইরূপ উভয় ব্যক্তিত্বের স্বামী-স্ত্রী দাম্পত্য সমস্যার কারণ। দুর্বল ব্যক্তিত্ব: পরনির্ভরশীলতা, সিদ্ধান্তহীনতা, দায়িত্ব নেওয়ার অক্ষমতা, অন্যের কথায় কান দেওয়া, গোপনীয়তা রক্ষা না করার দুর্বলতা, মেরুদন্ডহীন, হীনমন্য, আস্থার অভাব, খুঁতখুঁতে স্বভাব, নিজস্বতা রক্ষা করার দুর্বল মানসিকতা, সন্দেহপ্রবণ। ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ: আত্ম-অহমিকা, ব্যক্তিমর্যাদা ক্ষুন্ন করা, দমনীয় ভাব, নমনীয়তার অভাব, কর্তৃত্বপরায়ণতা, অতিরিক্ত মেজাজ, ও আবেগ প্রবণতা, গ্রহণশীলতা অভাব, প্রবল আত্ম-মর্যাদাবোধ, স্বার্থপরতা, পেশী শক্তি প্রয়োগ প্রবণতা, অস্বচ্ছতা, গোয়ার্তুমি ভাব, অনাস্থা, আপোষহীন মানসিকতা, জেদ, জবাবহিদিতার ভাব, দোষ খোঁজার মানসিকতা ইত্যাদি।
২। বিবাহের মূল উপাদান: দু’জন নর-নারীর পারস্পারিক সম্মতি বিনিময়-ই বিবাহ। সম্মতির মধ্যে যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে সেটাই বিবাহের মূল উপাদান। আর দাম্পত্য জীবনে বিবাহে প্রতিশ্রুত সেই উপাদানের অনুপস্থিতি এবং এর অভাবই দাম্পত্য সমস্যার কারণ। যেমন- ভালোবাসার অভাব, বিশ্বাস ও বিশ্বস্ততার অভাব অর্থাৎ অবিশ্বস্ত, যৌনাচার, বহুগামিতা, দৈহিক যৌন সম্পর্কে অক্ষমতা, পুরুষত্বহীনতা, সমকামিতা, যৌন বিকৃতি পাশবিকতা, যৌন মিলনে অনিহা এবং এড়িয়ে চলা, সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা, দায়িত্ব জ্ঞানহীন ভবঘুরে, ভুল-সঙ্গী নির্বাচন।
৩। পারিপার্শ্বিক কারণ: এখানে বাইরের কোন শক্তি বা তৃতীয় কোন শক্তি বা পক্ষ বা পারিপার্শ্বিক কোন এজেন্ট দাম্পত্য সমস্যায় কারণ হয়ে আসে। এর মধ্যে পিতা-মাতা, ভাই-বোন,শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ-ননাশ, কোন মিথ্যা গুজব, অন্যের পক্ষপাতিত্ব মনোভাব, অন্যের অতিরিক্ত আবেগ-সোহাগ, ঈর্ষা-প্রতিহিংসা, মদ-নেশা, অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা, বেকারত্ব, চাকুরী-পেশা, অসৎ ব্যবসা, মোবাইল, ফেসবুক, বন্ধুত্বের সম্পর্ক, অসততা, অতীত টেনে আনা রকমারি, বশ করা, চাকুরীর তাগিদে দূরে অবস্থান। সমস্যার ধরন: এই দাম্পত্য সমস্যার যে কারণগুলো রয়েছে এইগুলোর আবার গুরুত্বের মাপকাঠিতে তিন রকম এর পর্যায় বা ধরন রয়েছে। এইগুলো হলো ১। মৌলিক সমস্যা, ২। অমৌলিক সমস্যা ও ৩। অযৌক্তিক বা বিরক্তিকর সমস্যা।
১। মৌলিক সমস্যা: বিবাহের যে মূলভিত্তি এবং দাম্পত্য সম্পর্কে যে মূলশক্তি এবং নীতি তার মধ্যে যে দুর্বলতা এবং অভাবই হলো এই মৌলিক সমস্যা। আর যখন এই মূলভিত্তি এবং শক্তি দুর্বলতা প্রকটভাবে দাম্পত্য সম্পর্কে সক্রিয় হয়ে ওঠে তখন দাম্পত্য জীবনটাকে ভয়ানক অনিশ্চিয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে। তখন সেটা দাম্পত্য জীবন টিকিয়ে রাখার জন্য বড় হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। বিবাহের মূল হলো পারস্পরিক ভালবাসা, বিশ্বস্ততা, একতা ও সম্পূর্ণ আত্মদান। পরস্পরের অধিকার প্রতিষ্ঠার এবং মর্যাদা দানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকা আর পারস্পরিক দাম্পতিক দায়িত্বশীলতায় স্বচ্ছতা এবং সর্বোচ্চ নিশ্চয়তা দান। এক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসার অভাব, অবিশ্বস্ততা, পর-পুরুষ পর-নারীতে আসক্তি সম্পর্ক, বহুগামিতা, ব্যভিচার, শারীরিক দুর্বলতা ও অক্ষমতা, শারীরিক যৌন সম্পর্ক গড়তে ব্যর্থতা এবং অনীহা, যৌন বিকৃতি এবং সমকামিতা, একেবারেই ভুল সঙ্গী নির্বাচন, মানসিক বিকারগ্রস্ততা, ব্যক্তিত্বের দুর্বলতা, পরনির্ভরশীলতা, সন্দেহবাতিকতা এবং দায়িত্ব কর্তব্যে উদাসীনতা এবং অবহেলা, প্রতারণা ও অসততা, নেশাসক্তি।
২। অমৌলিক সমস্যা: এটা মূলে কোন সমস্যা নয় যা দাম্পত্য সম্পর্ক নষ্ট করে দেওয়া বা শেষ করে দিতে পারে তবে এটা প্রতিদিনের সম্পর্কের মধ্যে অশান্তি, অস্থিরতা এবং উত্তেজনাকর পরিস্থতির সৃষ্টি করে যায়। যেমন মদ-নেশা, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, সবকিছুতে সামান্য কিছুতে উত্তেজনা-রাগারাগি, অধৈর্য ও তর্কাতর্কি, দুর্বল ব্যক্তিত্ব, গুজবে বিশ্বাস করা, টাকা-পয়সা, বেতন-ভাতার অস্বচ্ছতা, পেশাগত গোপনীয়তা, মিথ্যাচার, তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ ও বাড়াবাড়ি, অভাব-অর্থ সংকট ও বেকারত্ব, যৌন সম্পর্কে স্বার্থপরতা এবং অবিবেক হওয়া, স্বামী বিদেশে থেকে স্ত্রী সন্তানদের জন্য টাকা না পাঠানো, স্বামী-স্ত্রীর কাজ ও রোজগারের মর্যাদার লড়াই, ব্যক্তিত্বের সংঘাত, দ্বন্দ, অসামাজিক কার্যকলাপ, অনৈতিক জীবন ও ব্যবসা।
৩। বিরক্তিকর সমস্যা: এই সমস্যা সচরাচর দাম্পত্য জীবনে সম্পর্কে এবং পরিবারে একটু না একটু লেগেই থাকে বা স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের অসচেতনতার জন্য বা ইচ্ছাকৃতভাবে হয়ে থাকে। এইগুলো হলো বিরক্তিকর সমস্যা যা সয়ে যায়, আবার সময় সময় মাথা গরম করে আবার অবান্তর জ্বলান্তর সৃষ্টি করে। যেমন ছোট-খাট বিষয়ে খুঁত ধরা, পারস্পরকে এপ্রিশিয়েট না করা, সময়মত কিছু না করা, সময় না দেওয়া, পক্ষাবলম্বন করা, যার যার মা-বাবার পক্ষে কথা বলা, ঠিক সময়ে ঘরে না ফেরা, একে অন্যের সম্বন্ধে এবং তাদের পরিবার নিয়ে খোঁচা মেরে কথা বলা, সময় মত বাজার না করা, মোবাইলে লুকিয়ে বা এড়িয়ে কথা বলা, দাম্পত্য যৌন সম্পর্কে পরস্পরকে না বুঝা, মিথ্যা কথা বলা, কাজের সঠিক মূল্যায়ন না করা, পরস্পরের কাজের খোঁজ খবর না রাখা, অসুস্থতায় খেয়াল না করা, পরস্পরে যতেœ খেয়ালে ঘাটতি, সংসারের প্রয়োজনে বেখেয়ালীপনা, নেশায় বদ অভ্যাস, জেদ গোয়ার্তুমি ভাব, কথা ও আচরণে রুক্ষতা, পরস্পর কথা বলা বন্ধ করে দেওয়া, রান্না-বান্নার ব্যাপারে বিরূপ মন্তব্য করা, পরস্পর চাহিদা পূরণে খেয়ালীপনা এবং অনীহা, গুজবে কান দিয়ে ভুল বুঝা, খুঁতখুঁতেপনা, অতীত টেনে আনা, স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের কথাববার্তা অন্যের কাছে বলে দেওয়া, কোন ঘটনা লুকানোর চেষ্টা, সন্তান না হওয়ার ব্যাপারে পারস্পরিক দোষারোপ করা, প্রয়োজনে ডাক্তারের কাছে না যাওয়া, বৌ-শাশুড়ি ও শ্বশুরের মধ্যে আন্তরিকভাবে গ্রহণ না করার জের, অহেতুক সন্দেহ, কোন কিছু চাওয়া না পাওয়ায় অধৈর্য হওয়া, অতিরিক্ত কৌতুহল হওয়া, অতিরিক্ত পীড়াপীড়ি, অন্যেরটা দেখে তুলনা করা, সংসার স্রোতে নতুনত্বের অভাব, বিনোদনের অভাব, সংসারে অভাব-অস্বচ্ছলতা, গায়ে হাত তোলা, পারিবারিক কড়াকড়ি নিয়ম, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ করা, অনেক সময় দেখা যায় স্বামী-স্ত্রীর অসতর্কতা, অসচেতনতা এবং বোঝাপড়ায় অবহেলার কারণে এই সব বিরক্তিকর সমস্যাগুলোও বড় আকার ধারণ করতে পারে।
আবার অন্যদিকে উভয়ের সচেতনতা, প্রয়োজনীয় দৃঢ় আন্তরিক পদক্ষেপ এবং পারস্পরিক ক্ষমা সহনশীলতার মধ্যে দিয়ে অনেক মৌলিক গুরুতর সমস্যারও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ উন্মুক্ত করতে পারে।
লেখক: আন্তঃমান্ডলিক ট্রাইবুনাল ঢাকা এর জুডিসিয়াল ভিকার এবং ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশে খ্রিস্টীয় পারিবারিক পরামর্শ কেন্দ্রের পরিচালক।
