তমব্রু ও কুতুপালং ক্যাম্প পরিদর্শন নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিরা বললেন রোহিঙ্গা সংকটের জাদুকরি সমাধান নেই
তরিকুল ইসলাম ঢাকা, স. ম গফুর উখিয়া থেকে : রোহিঙ্গারা যাতে স্বেচ্ছায় নিরাপদে নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারে সেই লক্ষে কাজ করার অঙ্গীকার করেছে বাংলাদেশ সফররত নিরাপত্তা পরিষদ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন শেষে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ প্রতিনিধি দলের প্রধান পেরুর গুস্তাভো মেজার চুয়াদ্রা এমনটা জানিয়েছেন। প্রতিনিধি দলের প্রধান আরও বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের জাদুকরী কোনো সমাধান নেই। আমরা এই শরণার্থী সংকট দেখে খুব উদ্বিগ্ন। আমরা এই পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। রোহিঙ্গাদের জন্য যেন কিছু করতে পারি, তাই সমস্যাটিকে আরও ভালোভাবে জানার জন্য আমরা এখানে এসেছি।
রোববার সকালে তারা প্রথমে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তমব্রু কোনারপাড়ায় সীমান্তের শূন্যরেখায় আশ্রয় নিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ঘুরে দেখেন। সেখানে তারা রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলেন, তাদের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।এক ঘণ্টার বেশি সময় সেখানে কাটিয়ে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা যান উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। সেখানে তারা ইউএনএইচসিআর, আইওএমসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কার্যক্রম ঘুরে দেখেন এবং তাদের তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের মতামত শোনেন। পরিদর্শন শেষে কুতুপালং ক্যাম্পে একটি ছাউনিতে সাংবাদিকদের সামনে আসেন নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা।
সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধি কারেন পিয়ার্স বলেন, বাংলাদেশ সফর শেষে আমরা মিয়ানমারে যাবো। তাদের কাছ থেকে শুনতে চাইবো, এ সংকট সমাধানে তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হতে পারে। কারেন পিয়ার্স বলেন, “এই সংকট থেকে উত্তরণে নিরাপত্তা পরিষদ বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার সরকারকে আন্তরিকভাবে সহায়তা দিতে চায়। তবে নিরাপত্তা পষিদের কোনো ব্যর্থতার কারণে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়নি। তাদের যেভাবে মূল ধারা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, যে ব্যবহার তাদের সাথে করা হয়েছে, সেটাই আছে এ সমস্যার মূলে। ফলে তারা বাধ্য হয়েছে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে।”
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইনে ওই অভিযান শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অধিকাংশ দেশ ও সংস্থা রোহিঙ্গা নিপীড়নের ঘটনায় সমালোচনায় মুখর হলেও মিয়ানমারের মিত্র চীন ও রাশিয়া সেনা অভিযানের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিল। জাতিসংঘে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাসের ক্ষেত্রে ওই দুই দেশের বিরোধিতাও এসেছিল। অবশ্য এখন এই দুই দেশ রোহিঙ্গা সঙ্কটের সুষ্ঠু সমাধানের কথা বলছে।
কুতুপালংয়ের সংবাদ সম্মেলনে নিরাপত্ত পরিষদে রাশিয়ার উপ স্থায়ী প্রতিনিধি দিমিত্রি পোলিয়ানস্কি বলেন, “সিকিউরিটি কাউন্সিলের ওপর অনেক প্রত্যাশা। কিন্তু আমাদের হাতে কোনো ম্যাজিক সলিউশন নেই। আমরা সম্ভাব্য সবচেয়ে ভালো সমাধানটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করব। সেজন্যই বাংলাদেশে এখানে এবং মিয়ানমারের পরিস্থিতি আসলে কেমন, তা দেখা আমাদের জন্য জরুরি ছিল।” রাশিয়ার প্রতিনিধি বলেন, “আমরা এখনও দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ভিত্তিতে এই সমস্যা সমাধানের পক্ষপাতী। আমরা দুই দেশের সরকারকেই বোঝাতে চেষ্টা করছি যেন তারা গঠনমূলক আলোচনা চালিয়ে যায়। আর আমরাও নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা করে সম্ভাব্য সবচেয়ে ভালো সমাধানটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করব।” নিরাপত্তা পরিষদে এ সঙ্কট নিয়ে আলোচনার কথা মনে করিয়ে দিয়ে পোলিয়ানস্কি বলেন, “আমরা আলোচনা থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিচ্ছি না, চোখ বন্ধ করেও থাকছি না। সে কারণেই আমরা আজ এখানে এসেছি।”
নিরাপত্তা পরিষদে চীনের উপ স্থায়ী প্রতিনিধি উ হাইতাও বলেন, “আমরা এখনই কোনো সমাধান বা সিদ্ধান্ত দিয়ে দেওয়ার জন্য হয়ত প্রস্তুত নই। আমি বলতে চাই, এখানে এসে, ক্যাম্প পরিদর্শনের মধ্যে দিয়ে, কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার মাধ্যমে আমাদের মিশন শুরু হল। যে পরিমাণ সাংবাদিক এখানে আছেন, তাতে স্পষ্ট যে বিষয়টি মিডিয়ার কতটা মনোযোগে আছে। “আমি বলতে চাই, আমরা এখানে প্রমোদ ভ্রমণে বা ছুটি কাটাতে আসিনি। আমরা এখানে এসেছি কারণ এটাকে আমরা গুরুতর সঙ্কট বলে মনে করছি এবং সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছি।’
সফররত নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দল সদস্যদের ব্রিফ করতে গিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, এ সফর রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। প্রতিবেশি মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের কখনোই কোনো সংঘর্ষ বা সমস্যা হয়নি। বরং নেপিডোর একাধিক বিপদের সময় পাশে থেকেছে ঢাকা। অথচ মিয়ানমারের সৃষ্টি করা রোহিঙ্গা সঙ্কটের কারণে নানামুখী ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান আন্তর্জাতিকভাবেই করতে হবে। ব্রিফিং-এ তিনি রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে তথ্যবহুল একটি প্রতিবেদন তাদের সামনে তুলে ধরেন।
বাংলাদেশে জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধি মিয়া সেপ্পো প্রতিনিধি দলকে ব্রিফিংয়ে বলেন, আশ্রয় প্রার্থীর সংখ্যা অনেক কিন্তু ত্রাণের পরিমান সীমিত। সামনের বর্ষা মৌসুমে এই রোহিঙ্গা পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে। তার আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে। রোহিঙ্গা সঙ্কটে বাংলাদেশও ঝুঁকিতে রয়েছে। রোহিঙ্গা নির্যাতনের সুবিচার হওয়া জরুরী। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের নাটকীয়তার ঠিক এ সময়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সফরকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে ঢাকা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, দেশটি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তরিক না। এ পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপ জরুরি। নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে ভেস্তে যেতে পারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ। মিয়ানমারে যে ধরনের নিষ্ঠুর নিপীড়ন চলেছে তা গণহত্যার শামিল। তবে নিরাপত্তা পরিষদ চাইলে আইসিসিতে তাদের বিচার করা সম্ভব। বাংলাদেশ চায় উভয় দেশ সফরের মধ্যদিয়ে নিরাপত্তা পরিষদ পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করুক।
নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দলটি বিশেষ ফ্লাইটযোগে কুয়েত থেকে শনিবার বিকেলে সরাসরি কক্সবাজারে আসেন। রোববার সকালে জিরো পয়েন্ট সীমান্ত এবং কুতুপালং ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের দেখতে যান। কথা শোনেন রোহিঙ্গাদেও দুর্দশার কথা। প্রতিনিধি দলটি রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনের পর বিকেলে ঢাকায় ফিরেন। পরে রাতে রাজধানীর একটি হোটেলে তাদের সৌজন্যে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের দেওয়া নৈশভোজে অংশ নেন। আজ সকালে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করবে প্রতিনিধি দলটি। এর পরপরই মিয়ানমারের উদেশ্য হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করার কথা রয়েছে বাংলাদেশ সফররত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ প্রতিনিধি দলের।