জয়তু কামাল লোহানী, আপনার বাণী হোক দুর্ঘটনারোধের দিশা!
মোহাম্মদ আলী বোখারী, টরন্টো থেকে
উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা, সাংবাদিক ও লেখক কামাল লোহানী আমার সহধর্মীনির চাচা। তিনি আমাদের বিয়েতে লেডিস ক্লাবে এসে আশীর্বাদ করেছেন। এই মে দিবসে তার কণ্ঠে দেয়ালে পিঠ ঠেকার মতো প্রতিবাদ শোনা গেল। সেটিকে এই সুদূর প্রবাসে বসে নিষ্ফল অন্তরাত্মাদাহে সমর্থন জানানোটা কর্তব্য মনে করছি। কেননা তিনি বাংলাদেশের সড়কে দিবানিশ অহরহ মৃত্যুর মিছিলের বিরুদ্ধে দিশা জাগানোর মতো প্রতিবাদী হয়েছেন। এমন কণ্ঠ একসময়ের চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন সংগঠন গড়ে বহু বছর ধরে সকলকে সজাগ করতে সচেষ্ট। কিন্তু বেপরোয়া ও লাগামহীন মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না। কারণ গাড়িচালকদের ঔদ্ধত্য আইনের বাধ্যবাধকতাকেও হার মানিয়েছে। রাস্তায় বাসের ঘষায় হাত হারানো একজনের লাশ হাসপাতাল ছাড়তেই আরেকজনকে অনুরূপ আহত করে হাসপাতালে নিয়ে আসছে। গার্মেন্টসের কর্মীজীবী নারী গাড়িচাপায় পা পিষ্ঠ হয়ে মারা যাচ্ছে। লেগুনা থেকে ইডেন কলেজের ছাত্রী ছিটকে পড়ে নির্বিকার মৃত্যুমুখে ঢলে পড়ছে। রাজধানীতে অনূর্ধ্ব ১৮ বছরের বালকরা নাকি লেগুনা চালায়! অজুহাত খুঁজে ব্রেক ফেইল্ড ডাবল ডেকার আইল্যান্ডে উঠে যায়। এমনকী যাত্রী পরিবহনগুলোর ভাঙাচোরা ও রংচটা দেহ দেখলে বোঝা যায়, সেগুলো কতটা জবাবদিহিতাহীন উন্মত্ততায় চলে, যা পশ্চিমা বিশ্বে কখনো কল্যুশন সেন্টারে রিপোর্টিং ও স্টিকার লাগানো ছাড়া পুলিশের নজর এড়ায় না। এ যেন ক্রমান্বয়ে এক অসভ্য ও ভয়াবহ পরিস্থিতির পানে বাংলাদেশ ধাবিত!
তাই কামাল লোহানী বাস-ট্রাক চালক-শ্রমিকদের যথোপযুক্ত শাস্তির বিপরীতে অবস্থান নেওয়ায় নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের মন্ত্রিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। গত মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আরণ্যক নাট্যদলের মে দিবসের বক্তৃতায় তার ওই ক্ষোভ প্রকাশ পায়। তিনি বলেন, ‘সড়কে চালকদের যোগ্যতা নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠছে, যখন মানুষ মারার অপরাধে তাদের মৃত্যুদ-ের দাবি ওঠে, তখন তার বিপরীতে অবস্থান নেন মন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি বলছেন, চালকদের কুকুর-বেড়াল চিনলেই হবে। এই … লোকটি কী করে মন্ত্রী হয়?’ আরো বলেন, ‘আজকে আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এক বাংলাদেশ গড়ার কথা বলছি, তখন সেই বাংলার মন্ত্রিসভায় এই … লোকটি কী করে সদস্য হন? তিনি একইসঙ্গে শ্রমিক আন্দোলন করছেন, আবার মন্ত্রিত্বও জাহির করছেনÑ এটা কী করে সম্ভব?’ একইসঙ্গে নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী রাজনীতিক শামীম ওসমানের বিরুদ্ধেও ক্ষোভ ব্যক্ত করেন। বলেন, ‘বাসচালক-শ্রমিকদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে তিনি এখন সেই টাকার জোরে মানুষ কিনে নিচ্ছেন।’ এসময় কামাল লোহানী জানান, দেশের ‘বহুল প্রচারিত’ একটি পত্রিকায় শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে লেখা পাঠালেও তা প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরে আসে। বলেন, ‘৬২ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে দেখলাম না কোনোদিন লেখা ফিরে এসেছে। লেখা হয় ছাপা হবে, না হলে তা ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত হবে। কোনোদিন ফিরে আসেনি লেখা। আমি সেই বহুল প্রচারিত দৈনিকের একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। উত্তরে বললেন, এ নিয়ে আর জিজ্ঞাসা করবেন না। অর্থের জোর বড় সাংঘাতিক!’ পাশাপাশি তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় সরকার মুক্তবাক ও মুক্তকণ্ঠ রোধ করতে চায় বলেও অভিযোগ করেন। এতে যুগপৎ তিনি আইনমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রীরও কঠোর সমালোচনা করেন।
মে দিবসের ওই আলোচনায় যোগ দিয়ে কামাল লোহানী হতাশায় বলেন, ‘শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্বের পুরোভাগে থাকা বিরাট হৃদয় অগ্নিগর্ভ চোখগুলো বন্ধ হয়ে আসছে’! পরে তিনি শিশু শ্রমের বিরুদ্ধেও সবাইকে সোচ্চার হতে বলেন। ওই আলোচনায় প্রধান নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদও নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের সমালোচনা করেন। তিনি সড়কে দুর্ঘটনা ও ধর্ষণের বিপরীতে দায়ী বাসচালক ও শ্রমিকদের পক্ষ নেওয়ায় তাকে বিচারের কাঠগড়ায় তোলার দাবি জানান।
তাই সুদূর প্রবাস থেকে এই সাহসী কণ্ঠগুলোর প্রশংসা নয়, বরং চাই তাদের উচ্চারিত বাণী থেকে আমাদের সম্বিত জাগানোর মতো শিক্ষণীয় সরকারের দায়-দায়িত্ব ও কঠোর আইনের চর্চা; যাতে রাস্তায় বেরিয়ে অসহায় মানুষগুলোকে লাশ হয়ে ফিরতে না হয়। যেন দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা আমাদের বিপথগামী না করে এবং তাদের খামখেয়ালিপনা বক্তব্যে আমরা যেন কখনো নিশ্চুপ না থাকি।
ই-মেইল: নঁশযধৎর.ঃড়ৎড়হঃড়@মসধরষ.পড়স