অধীনস্থদের অধিকার সম্পর্কে ইসলাম
দিলাওয়ার আহমদ কাসেমি
শ্রম দিয়ে জীবিকা নির্বাহ, ইসলামের অন্যতম একটি সৌন্দর্য। দুনিয়াতে জীবন-যাপনের জন্যে সম্পদের প্রয়োজন অনিবার্য। তাই ইসলাম বৈধ পন্থায় উপার্জন করাকে সবসময় উৎসাহ দিয়ে আসছে। কাজ বড় হোক বা ছোট যদি তা বৈধ পন্থায় হয় তাহলে অবশ্যই তা সম্মানের। ইসলামে বৈধ কোন পেশাকে খাটো করে দেখার অনুমতি দেয়নি। আর মানুষ তো সহজাতভাবেই রিযিক অন্বেষণের পেছনে ছুটে চলে। এই রিযিক অন্বেষন করা, জীবনধারণের উপকরণ সন্ধান করা ইসলামি শরিয়তের একটি সুস্পষ্ট নির্দেশ। অপরদিকে তেমনি ইসলামে বৈরাগ্যবাদের কোন স্থান নেই। কুমারজীবন, দুনিয়াবিমুখতা ও সংসার-বিরাগ অসুন্দর কাজ এবং জাহেলি দর্শন। আমাদের ধর্মে কেবল গিরিগুহা কিংবা মসজিদে বসে বসেই আল্লাহর নাম জপ করার পুরুষ নেই। বরং জীবনের নানা টানাপোড়েন, উপার্জনের তাকিদে দৌঁড়ঝাপ এবং কারবারের ব্যস্ততার মধ্যেও আল্লাহকে ভুলে না-যাওয়া পুরুষের পরিচয়। এই ধর্মে শুধু আল্লাহর স্বরণ ও তাঁর ইবাদতের কথাই বলা হয়নি বরং নামাযের পর জীবিকা অন্বেষণের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসাসহ মৌলিক প্রয়োজন পূরণে জীবিকার বিকল্প নেই।
মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘নামায সম্পন্ন হলে তোমরা ছড়িয়ে পড়ো যমিনে এবং তালাশ করো আল্লাহর ফাজল বা অনুগ্রহ। (সুরা জুমা:১০) অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তোমাকে (দুনিয়ায়) যা দিয়েছেন তা দ্বারা তুমি আখেরাতের আবাস অনুসন্ধান করো। এবং দুনিয়ার জীবনে তোমার অংশের কথা ভুলে যেয়ো না। (সুরা কাসাস: ৭৭)
বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ এবং ইসলামের ইতিহাস অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, যুগে যুগে এ নির্দেশনা মোতাবেক নবি-রাসুলগণ নিজের জীবন পরিচালনা করেছেন। হজরত আদম (আ.) কৃষিকাজ ও তাঁতের কাজ করতেন। হজরত হুদ ও সালেহ (আ.) ব্যবসায়ী ছিলেন। হজরত শুয়াইব (আ.) পশু বিচরণ করাতেন এবং এগুলোর দুধ বাজারে বিক্রি করতেন। হজরত দাউদ (আ.) লোহা দিয়ে নানা ধরনের যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করেছেন। হজরত মুসা (আ.) দীর্ঘ আট বছর ভেড়া চড়ান। আমাদের প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মদ (স.) বকরি পালন ও ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন। সভ্যতার এ সময়েও পত্রিকার পাতা খুলতেই শ্রমিক নির্যাতনের খবর ভেসে ওঠে। কল-কারখানার শ্রমিক তো বটেই, গৃহের শ্রমিকও বাদ যাচ্ছে না নির্যাতন থেকে। ঠুনকো অভিযোগে শ্রমিককে মারধর করার অধিকার কিছুতেই দেয়নি ইসলাম। হজরত আবু মাসউদ (রা.) বলেন, আমি আমার চাকরকে মারধর করছিলাম। আমি পেছন থেকে আওয়াজ শুনতে পেলাম, ‘সাবধান আবু মাসউদ! তুমি তোমার গোলামের ওপর যতটুকু ক্ষমতা রাখো, আল্লাহ তোমার ওপর এর চেয়ে বেশি ক্ষমতা রাখেন।’ আমি পেছনে ফিরে দেখি, তিনি আমার প্রাণের নবী। আমি তখন বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমি তাকে আল্লাহর জন্য আজাদ করে দিলাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বললেন, তুমি যদি তাকে মুক্ত না করতে তবে অবশ্যই তোমাকে আগুনে জ্বলতে হতো।’ (সহিহ মুসলিম : ৫/৯২)
শ্রমিকের পাওনা যথাসময়ে পরিশোধের ব্যাপারে মহানবী (সা.) এর মতো এত কঠোর হুঁশিয়ারি আর কেউ উচ্চারণ করেননি। অনতিবিলম্বে মজুরি প্রদান করার ব্যাপারেও তিনি ছিলেন সবচেয়ে আন্তরিক। মজুরির প্রশ্নে মানবসভ্যতার ইতিহাসে শীর্ষে অবস্থান করছে তাঁর বাণী। তিনি ইরশাদ করেন, তোমরা শ্রমিকদের গায়ের ঘাম শুকাবার আগে তাদের প্রাপ্য মজুরি পরিশোধ করে দাও। (সুনানে ইবনে মাজা : ২৪৪৩, মুসনাদে আবু ইয়ালা ৬৬৮২)
এ সম্পর্কে নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, এরা (অর্থাৎ, চাকর-বাকর, কর্মচারী, ক্রীতদাস ইত্যাদি) তোমাদের ভাই, তোমাদের খেদমতগার। আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। সুতরাং যার ভাই তার অধীন রয়েছে, তাকে যা সে নিজে খায় তা থেকে খেতে দেবে। যা সে নিজে পরে, তাই তাকে পরাবে। তাদের উপর এমন কাজ চাপিয়ে দেবে না, যা তাদের পক্ষে পালন করা অধিক কষ্টকর। আর যদি তাদের উপর অধিক কষ্টকর কোনো কাজ চাপিয়ে দিয়ে থাক, তবে তাদেরকে সাহায্য কর। (সহিহ বুখারি: ২৫৪৫, সহিহ মুসলিম: ১৬৬১)