জিকিরের প্রকার ও পদ্ধতি
হাবীবুল্লাহ সিরাজ
জিকির একটি ইবাদত। সহজ ও কষ্টবিহীন ইবাদত। অপরাপর ইবাদতগুলোতে কষ্ট সাধন করতে হয়। কিন্তু জিকিরের ক্ষেত্রে কোনো কষ্টই সইতে হয় না। এ ছাড়াও খাঁটি মুমিনের শান হলো জিকির। জিকির ছাড়া খাঁটি মুমিন হওয়া কল্পনাতীত। পৃথিবীর বুকে যত নবী-রাসূল, ওলি-আল্লাহ, বুজুর্গ ছিলেন সবার সব সময়ের আমল ছিল জিকির।
জিকিরে দিল তাজা হয়, সতেজ হয়, তরতাজা থাকে, জিন্দা থাকে হৃদয়ের অন্দর। হাদিস শরিফে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আবু মুসা আশয়ারি রা: থেকে বর্ণিত, যে ব্যক্তি স্বীয় পালনকর্তার কথা স্মরণ করে আর যে করে না তাদের উভয়ের দৃষ্টান্ত যথাক্রমে জীবিত ও মৃত। জিকির দিয়ে অন্যান্য ইবাদতের মজা ও স্বাদ পাওয়া যায়। এক হাদিসে আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যার ভাষ্য প্রায় এ রকম, বান্দাহ যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহকে স্মরণ করে, আল্লাহ ততক্ষণ ওই বান্দাহকে স্মরণ করে। ইবাদতের মর্মকথা হলো, আল্লাহকে সব সময় স্মরণ করা। আল্লাহর চিন্তা-ফিকির হৃদয়ে সদা জাগ্রত রাখা। এ কারণে দৈনন্দিন ইবাদত নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। যেন আল্লাহকে বান্দাহ সব সময় স্মরণ করতে বাধ্য হয়। এতে বোঝা যায় নামাজ, রোজা প্রভৃতি ইবাদত হলো আল্লাহকে স্মরণ করার মাধ্যম। আর জিকির হলো মাধ্যম ছাড়া আল্লাহকে স্মরণ করা। এক স্থানে আল্লাহ নিজেই ঘোষণা দেন- ‘আকিমিস সালাতা লিজিকরি’। অর্থাৎ নামাজ আদায় করো আমার স্মরণের জন্য।
ওলামায়ে কেরাম জিকিরের প্রকারভেদ বর্ণনা করেছেন। জিকির অন্তর দিয়েও হয়, জবান দিয়েও। এ হিসেবে জিকির দুই প্রকার। কালবি, জবানি। এ দু’য়ের মধ্যে কালবি উত্তম। কালবি জিকির আবার দুই প্রকার ক. অন্তরে আল্লাহর মহত্ত্ব, বড়ত্ব, কুদরতের কথা স্মরণ করা। খ. আল্লাহ তায়ালা যে বিধিবিধান দিয়েছেন তা আদায় করার সময় আল্লাহর কথা স্মরণ করা। জিকিরে কালবির প্রথম প্রকারকে জিকিরে খফিও বলে। বুজুর্গদের বর্ণনায় পাওয়া যায়, জিকিরে খফি সত্তর গুণ বেশি মর্যাদার অধিকার রাখে। এমনকি আমল লেখা ফেরেশতারাও সে সম্পর্কে অবগত নয়। ঘটনা বর্ণনা করা হয় (যদিও তা দুর্বল)
কিয়ামতের দিন বান্দাহর হিসাব-নিকাশের জন্য যখন একত্র করা হবে, তখন আমল লেখক ফেরেশতারা তার সব রেকর্ড পেশ করবে। আল্লাহ বলবেন, ভালো করে দেখো আমার বান্দার আরো কিছু আমল আছে কি না? আমল লেখক ফেরেশতা বলবে, ‘হে পরোয়ারদেগার! আপনি আমার দ্বারা যা রেকর্ড করিয়েছেন আমি তা পুঙ্খানুপুঙ্খ পেশ করেছি।’ তখন আল্লাহ বান্দাহকে বলবেন, তোমার এমন কতগুলো নেকি (আমল) আছে যা আমি ছাড়া অন্য কেউ জানে না। আমি আজ তার প্রতিদান দেবো। আর ওই আমল হলো জিকরে খফি (অনেক ওলামায়ে কেরাম জিকরে খফিকে এত মূল্যায়ন করেন না)।
জিকিরের ফজিলত: জিকিরের মাধ্যমে বান্দাহ আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে। মানুষ তার কথাই বেশি স্মরণ করে, যার সাথে তার সম্পর্ক বেশি। সুতরাং আল্লাহর প্রেমিক হওয়ার জন্য আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করতে হবে। আর স্মরণ করার সবচেয়ে সহজ তরিকা হলো জিকির। ইমাম বুখারি-মুসলিম উভয়ে নিম্নোক্ত হাদিসটি এনেছেন। যাতে জিকিরের একটি অনন্য ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে যে, আল্লাহ বান্দাহকে স্মরণ করে। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ বলেন, ‘আমি বান্দাহর নিকট সেরূপ যেরূপ বান্দাহ আমাকে ভাবে। আমি তার সাথে থাকি যখন সে আমাকে স্মরণ করে। যদি সে আমাকে স্মরণ করে মনে, আমি তাকে স্মরণ করি মনে। যদি সে আমাকে স্মরণ করে ভরপুর কোনো মজলিশে, আমি তাকে স্মরণ করি তার চেয়ে উত্তম কোনো মজলিশে।’
জিকিরকারী ও জিকিরের মজমাকে রহমতের ফেরেশতারা বেষ্টন করে রাখে এবং অহরহ তাদের ওপর রহমত-বরকত বর্ষিত হতে থাকে। হজরত আবু হুরায়রা ও আবু সাঈদ খুদরি থেকে বর্ণিতÑ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যেকোনো মানবদল আল্লাহর জিকির করতে বসে, নিশ্চয় আল্লাহর ফেরেশতারা তাদের বেষ্টন করে নেয়। তাঁর রহমত তাদের ঢেকে ফেলে এবং তাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হয়। আল্লাহ তাদেরকে স্মরণ করেন।’ (মুসলিম)।
জিকিরের ফজিলত অল্প কোনো বিষয় নয় যে, তা দু-এক কথায় শেষ হয়ে যাবে। ফরজ ইবাদতের পরই জিকিরের গুরুত্ব, ওলি-আল্লাহরা সর্বদাই ইবাদতে মশগুল থাকতেন। তাদের সর্বদা ইবাদতে লিপ্ত হওয়ার বিষয়টি হলো জিকির। হজরত উম্মে হাবিবা রা: থেকে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ অথবা আল্লাহর জিকির ছাড়া প্রত্যেক কথাই আদম সন্তানের পক্ষে ক্ষতিকর, কল্যাণকর নয়। ’
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দৈনন্দিন আমলে জিকিরের প্রাধান্য ছিল। সাহাবায়ে কেরাম চলনে-বলনে, শয়নে-স্বপনে, চলাফেরায় সদাসর্বদা জিকিরে মশগুল থাকতেন। এ বিষয়ে স্বয়ং আল্লাহ আদেশ দিচ্ছেন, ‘সকাল-সন্ধ্যা আপনার পালনকর্তার নাম স্মরণ করুন’ (সূরা আদদহর : ২৫)। সূরা আহজাবে আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ অধিক পরিমাণে আল্লাহকে স্মরণ করো এবং সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করো (সূরা আহজাব : ৪১, ৪২)। এসব আয়াতের বাস্তবতা পাওয়া যায় নবী-রাসূল, মুমিনদের আমলে।
আল্লাহ জিকিরকারীদের প্রশংসা এভাবে করেছেন যে, ‘তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদের কথা স্মরণ করব’। (সূরা বাকারাহ : ১৫২)। এ আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে আবু উসমান মাহদি বলেন, ‘আমি জানি কখন আল্লাহ আমাকে স্মরণ করে। ‘লোকেরা বলল কীভাবে কখন’, উত্তরে তিনি বললেন, তিনি আমাকে স্মরণ করেন যখন আমি তার জিকির করি, আমি তা উক্ত আয়াত দ্বারা বুঝলাম।’ উল্লিখিত ফজিলত ছাড়া জিকিরের আরো বহুবিদ ফজিলত রয়েছে। এ সম্পর্কে বহু আয়াত ও সুদীর্ঘ হাদিস রয়েছে।