রাজনৈতিক কোটা বন্ধ করা উচিত
তাহমিদ জামান
বাংলাদেশে প্রথম শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথার সংস্কারের দাবিতে আমরা বিক্ষোভ আন্দোলন করছি। আমাদের এই ন্যায্য দাবিকে একদল সুবিধাবাদি লোক বলেছে, এটি নিয়ে বিক্ষোভ কেন? ১৯৭১ সালে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের সন্তান ও দেশের অনগ্রসরদের জন্য কোটা চালু করা হয়েছিল। কিন্তু ক্রমান্বয়ে এই কোটার পরিধি বেড়েছে। এখন মুক্তিযোদ্ধাদের নাতী-নাতনীদের জন্য এ কোটা প্রযোজ্য হচ্ছে। বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে এখন ২৫৮ ধরনের কোটা আছে। বাংলাদেশের পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সূত্রমতে প্রথম শ্রেণীর চাকরিতে মোট পাঁচটা ক্যাটাগরিতে কোটা রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কোটা। পৃথিবীর কোথাও স্থায়ীভাবে কোটা পদ্ধতি নেই বলে গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে। যেসব রাষ্ট্রে কোটা পদ্ধতি চালু রয়েছে, সেখানে নিয়মিতভাবে তা সংস্কারের মাধ্যমে যুগোপযোগী করে তোলা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে তা হয় না কেন? একটি দেশে কোটা পদ্ধতি বরাদ্দ দেওয়া হয় সাধারণত অনগ্রসর জনগণকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। সেক্ষেত্রে নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য পাঁচ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য এক শতাংশ, এই ১৫ শতাংশ কোটা নিয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। তবে ১০ শতাংশ জেলা কোটা কিংবা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা নিয়ে আমাদের আপত্তি। বর্তমান চাকরিতে জেলা কোটা বেশ হাস্যকর। দেশের ৬৪ জেলার মানুষের মধ্যে কেউ কারও চেয়ে বেশি সুবিধা পাবে-এটা বোধ হয় এখন আর কাম্য নয়। বলতে চাচ্ছি, জেলা কোটা প্রবর্তনের শুরুর দিকটায় এটা প্রাসঙ্গিক থাকলেও বর্তমান সময়ে এ রীতি বহাল স্বাভাবিক দৃষ্টিতে বিবেচনা করার সুযোগ নেই।
কারণ, এখন পিছিয়ে পড়া জেলা বলতে কিছু নেই। এটা বাতিল হয়ে গেলেই কোটাধারীর সংখ্যা কমে ৪৬ হয়ে যাবে। আর সাধারণ শিক্ষার্থী বেড়ে হবে ৫৪। বাংলাদেশ তার সামর্থ্যানুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা ও তার পরিবারকে আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করছে। প্রয়োজনে এটা আরও বর্ধিত করলে মুক্তিযোদ্ধাদের আমৃত্যু সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার সর্বাত্মক প্রয়াস রাষ্ট্র গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু কোটার ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আনুপাতিক হার দেখে মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরীদের কোটা তাদের সন্তান পর্যন্ত বর্ধিত রাখলেই বোধ হয় রাষ্ট্রের সবার জন্য মঙ্গল হতো। চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা নিয়ে যে আপত্তি উঠছে তা বোধ হয় মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনীদের পর্যন্ত বর্ধিত না হলে উত্থাপিত হওয়ার যৌক্তিকতা থাকত না। মনে রাখা চাই-কোটার বিরুদ্ধে যৌক্তিক কিছু বললেই কেউ রাজাকার হয়ে যায় না। বরং ‘নাতি কোটা’র মতো রাজনৈতিক কোটা বন্ধ করা উচিত। একই সাথে কোটাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারও বন্ধ করতে হবে।
পরিচিতি : শিক্ষার্থী, অধিভুক্ত সাত কলেজ/মতামত গ্রহণ : তাওসিফ মাইমুন/সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ
‘এখন আমরা সবাই মার্কসবাদী’!(শেষ পৃষ্ঠার পর) এমন সরকারের অধীনে ছিল, যারা নিজেদের মার্কসবাদী বলে দাবি করত। এর বাইরে বহু দেশে বামপন্থীদের অনুকরণীয় আদর্শ ছিল মার্কসবাদ এবং মার্কসবাদকে কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, সেটিই ছিল সেসব দেশের ডানপন্থীদের নীতিমালা। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তার ঔপনিবেশগুলোতে সমাজতন্ত্র ভেঙে পড়ার পরও সেখানে মার্কসের প্রভাব রয়ে গেছে।
বলাবাহুল্য, জার্মানির মোসেল নদীর তীরে ট্রিও, ইংরেজিতে ট্রেভেস গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৮১৮ সালের ৫ মে কার্ল মার্কসের জন্ম। রাজনৈতিক লেখালেখির কারণে তাকে উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নিতে হয় ব্রিটেনের লন্ডনে। সেখানেই তিনি জার্মান চিন্তাবিদ ফ্রেডরিক এঙ্গেলের সহযোগিতায় তার চিন্তাধারার পরিপূর্ণ স্ফূরণ ঘটান। ফলে ১৮৪৮ সালে স্থান পায় উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: ‘দ্য কমিউনিস্ট মেনোফেস্টো’ ও তিন খ-ে ‘ডাস ক্যাপিটাল’। বাস্তবে কার্ল মার্কসের সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির দর্শনটিই মার্কসবাদ, যার উত্তরণ ধনতন্ত্রের বুর্জোয়াশ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামেই অন্তর্নিহিত।
তাই অধ্যাপক সিঙ্গার লিখেছেন, নিজেদের মার্কসবাদী বলে দাবি করা শাসকেরা উৎপীড়কের ভূমিকায় থেকে মার্কসের সুনামে কালিমা লেপন করেছে; যদিও মার্কস নিজে কখনো এসব অন্যায়কে উৎসাহিত করার প্রমাণ নেই। সোভিয়েত ব্লক এবং মাও শাসিত চীনে সমাজতন্ত্র ভেঙে পড়ার মূল কারণটি হচ্ছে সেখানে সরকার পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে পাল্লা দেবার মতো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে জনগণকে মানসম্মত জীবনব্যবস্থা দিতে পারেনি। সেজন্য মার্কসের দেয়া সাম্যবাদের পরিম-লকে ত্রুটি বলে ধরে নেয়াটা ঠিক হবে না। কারণ সাম্যবাদী সমাজ কীভাবে চলবে, মার্কস কখনো সেই ব্যাপারে কখনো সচেষ্ট হননি। আমাদের বরং সেই ব্যর্থতাটি তলিয়ে দেখতে হবে, যেখানে মানুষের প্রকৃতি সম্পর্কে মার্কসের ভ্রান্তিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিটি রয়েছে। কেননা মার্কস মনে করতেন, বংশগত বা প্রকৃতিগত স্বভাবই মানুষের প্রথাসিদ্ধ। তার থিসিস অন ফয়েরবাখেই ‘মানুষের সামাজিক যূথবদ্ধতা’ সম্পর্কে রয়েছে, সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো বদলে ফেলার জন্য সামাজিক সম্পর্কসহ পুঁজিবাদী ও শ্রমিকদের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক বিলুপ্ত করা হলে দেখা যাবে পুঁজিবাদী সমাজে বেড়ে ওঠা মানুষের চেয়ে এই নতুন সমাজের মানুষ হবে একেবারে ভিন্ন প্রকৃতির। মার্কস সেটা উপর্যুপরি সমাজ বিশ্লেষণ করে শেখেননি, বরং তিনি ইতিহাস সম্পর্কে হেগেলের দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রয়োগ করেছেন। হেগেলের মতে, মনুষ্য চেতনার মুক্তিই ইতিহাসের লক্ষ্য। মার্কস সেই ‘ভাববাদ’কে ‘বস্তুবাদে’ রূপান্তর করে শ্রেণিসংগ্রামের মাধ্যমে ব্যক্তিসম্পদের চেয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদের মাধ্যমে যৌথমালিকানাভিত্তিক উৎপাদন ও বিশ্বজনীন মুক্তির সম্ভাবনাটি দেখেছেন। এ কারণে মার্কস আয় ও সম্পদ কীভাবে বণ্টন করা হবে, তা নিয়ে বিশদ আলোচনার প্রয়োজন বোধ করেননি। মার্কস যখন দুটি জার্মান সমাজতান্ত্রিক দলের একীভূত হওয়ার ব্যাখ্যা দেন, তাতে ‘সুষম বণ্টন’ ও ‘সমানাধিকার’-এর মতো শব্দগুচ্ছকে ‘সেকেলে মৌখিক বাজে কথা’ হিসেবে প্রতিপন্ন করেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রমাণ করেছে, বেসরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বিলুপ্ত করলেই মানুষের প্রকৃতিগত স্বভাব বদলায় না। বরং সর্বজনীন কল্যাণের কথা ভেবে নিজের হাতে ক্ষমতা ও অগ্রাধিকার চায়, অন্যদের চেয়ে বিলাসবহুল জীবন-যাপন চায়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, এখনো যে দেশটি নিজেরা মার্কসবাদের অনুসারী বলে দাবি করে, তাদের ইতিহাসে ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পদের চেয়ে যৌথ মালিকানাভিত্তিক সম্পদ প্রবাহ বেশি। মাও সেতুংয়ের আমলে চীনের বেশিরভাগ মানুষ দরিদ্র ছিল। মাওয়ের পর ১৯৭৮ সালে তার উত্তরসূরি দেং জিয়াওপিং (যিনি বলেছিলেন, ‘বিড়াল সাদা কি কালো সেটা বড় কথা নয়, সেটি ইঁদুর ধরছে কি না, সেটাই বড় কথা’) ক্ষমতায় থাকাকালীন চীনের অর্থনীতি দ্রুত সমৃদ্ধশালী হয়। এর কারণ, দেং জিয়াওপিং বেসরকারি উদ্যোগে উৎপাদন অনুমোদন দেন। সেই সংস্কারের কারণেই চীনের ৮০ কোটি দরিদ্র মানুষ ঘুরে দাঁড়ায়। একইসঙ্গে এই সংস্কার চীনে ইউরোপের যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করেছে। যদিও চীন এখনো বলছে, তারা ‘চীনের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের সমাজতন্ত্র’। যদিও অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় সেটির সঙ্গে মার্কসের সমাজতন্ত্রের কোনো মিল নেই। এখন যদি চীন মার্কসের ভাবাদর্শে প্রভাবান্বিত না হয়, তবে আমরা এই উপসংহারে আসতে পারি যে, চীনের অর্থনীতির মতো রাজনীতিতেও তিনি আর প্রাসঙ্গিক নন। তবু তার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাবটি রয়েই গেছে। ইতিহাস সম্পর্কে দেয়া তার বস্তুবাদী তত্ত্ব আমাদের মানবসমাজের চালিকাশক্তির গতি-প্রকৃতিটি অনুধাবনে সহায়তা করেছে। আর নেতিবাচক দিকটি হচ্ছে, ইতিহাসের বিবর্তনে ভাবধারা, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের প্রয়োজনমুখী স্বাধীন হয়নি, হয়নি অর্থনীতির প্রয়োজনে অর্থকরী প্রতিষ্ঠানগুলো। মনে হচ্ছে, সেই ভাবনাগুলোকে আমরা অন্তর্মুখী করে ফেলেছি। সেই দৃষ্টিকোণে এখন আমরা সবাই মার্কসবাদী।
ই-মেইল: নঁশযধৎর.ঃড়ৎড়হঃড়@মসধরষ.পড়স