একটি হাতও আর হারাতে চাই না
শান্তা ফারজানা
আর কোনদিনও রাজিবের চোখ দিয়ে পানি ঝরবে না। আর কোনদিনও হাতের ক্ষত দেখতে দেখতে ছটফট করবে না রাজিব। কোনদিনও আর ব্যান্ডেজ খুলে দিতে আকুতি ঝরে পড়বে না তার কন্ঠ থেকে। তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। রাজিবের মামা জাহিদুল ইসলামের সাথে সাথে কাঁদছে ১৭ কোটি মানুষ। সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে রোজ যত লোক প্রাণ হারান বা জখম হন, সেই পরিসংখ্যান শিউড়ে উঠার মতো।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠান এআরআই-এর হিসেবে গত দশ বছরে বাংলাদেশে ২৯ হাজার ৪৩২টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ২৬ হাজার ৬৮৬ জন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ২১ হাজার ৫৪৮ জন।জাতিসংঘে বাংলাদেশসহ সদস্যদেশগুলো অঙ্গীকার করেছিল ২০১১ ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। সেভ দ্য রোড এর রিসার্চ সেল এর তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় দিনে গড়ে ২৫ জন মারা যান। অবশ্য পুলিশের হিসাবে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান গড়ে ৬ জন। রিসার্চ সেল এর তথ্যনুযায়ী, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৮ হাজার ৬৪২ জন। আহত হয়েছেন ২১ হাজার ৮৫৫ জন। এর মধ্যে বাস দুর্ঘটনা এক হাজার ২৪৯টি, ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান দুর্ঘটনা এক হাজার ৬৩৫টি, হিউম্যান হলার ২৭৬টি, কার-জিপ-মাইক্রোবাস ২৬২টি, অটোরিকশা এক হাজার ৭৪টি, মোটর সাইকেল এক হাজার ৪৭৫টি, ব্যাটারিচালিত রিকশা ৩২২টি ও নছিমন-করিমনে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৮২৪টি। এসব দুর্ঘটনার হিসাব রাখে বাংলাদেশ পুলিশ।
বর্তমানে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা মহামারি আকার ধারণ করেছে। দুর্ঘটনার অনেক কারণ থাকে। তবে চালক-সর্বস্ব চিন্তাটা প্রকৃত কারণ না। এটা উপসর্গ।
চালকের যেমন ভুল আছে, তেমনি বিআরটিএ-র ভুল আছে, যারা সড়ক নির্মাণ করেন তাদের গাফিলতি ও ভুল আছে এবং এখানে যারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ মালিকেরও ভুল আছে। তারপর অনেক গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট নাই। ফিটনেস দেখাতোর দায়িত্ব মালিকের, চালকের নয়। বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ২৩ লাখ যানবাহনের মধ্যে ফিটনেসবিহীন যানবাহন রয়েছে ৩ লাখের বেশি। আর যেসব যানবাহনের ফিটনেস আছে, সেগুলোও যথাযথভাবে নেওয়া হয় না। কারণ, ৪০ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যানবাহনের সনদ দেওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ খালি চোখে একটু দেখেই ফিটনেস দিয়ে দেয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফিটনেস সনদ দেওয়ার যন্ত্র বিকল আছে এক যুগ ধরে।
দেশে চালকের লাইসেন্স আছে ১৬ লাখ। এরও একটা বড় অংশ দেওয়া হয়েছে যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া, শ্রমিক ইউনিয়নের দেওয়া তালিকা ধরে। অর্থাৎ প্রায় আট লাখ যানবাহনের কোনো চালক নেই। অথচ বাণিজ্যিক যানবাহনের প্রতিটির জন্য দুজন চালক দরকার হয়।
এ বিষয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সড়কের খারাপ-ভালো তো এর সঙ্গে জড়িত না। যারা চালাচ্ছে এবং গাড়িতে যারা আরোহী, তারা এর সঙ্গে দায়ী। হতে পারে ওই ছেলেটাও ভুল করতে পারে। তার দাঁড়ানোটা সঠিক নাও হতে পারে। এ ব্যাপারে চালকদের সচেতন হতে হবে।’ কোন একপক্ষকে এভাবে দায়ী করা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত তা নতুন প্রজন্মের পক্ষ প্রশ্ন রইলো।
মূলত সরেজমিনে তদন্তপূর্বক চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে ভবিষ্যতে সড়কসহ নৌপথ, রেলপথ এবং আকাশপথে সকল দুর্ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া যায়। অর্থাৎ তৃণমূল পর্যায়ে কারণ চিহ্নিত বিশ্লেষণ করে দুর্ঘটনার হার হ্রাস করা সম্ভব। কিন্তু এভাবে চিহ্নিত করা সম্ভবপর উঠে না ফলে ভবিষ্যতে একই ধরণের দুর্ঘটনার পুণরাবৃত্তি হয় এবং তা ‘আকস্মিক ঘটনা’ হিসেবেই রয়ে যায়।তাই ট্রাফিক আইন, মোটরযান আইন ও সড়ক ব্যবহার বিধিবিধান সম্পর্কে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ও সাধারণের মধ্যে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। একইসঙ্গে টিভি-অনলাইন, সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সড়ক সচেতনতামূলক বা দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
এছাড়াও জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশ হাট-বাজার অপসারণ, ফুটপাত দখলমুক্ত করা, রোড সাইন (ট্রাফিক চিহ্ন) ¯’াপন করা, জেব্রাক্রসিং দেওয়া, চালকদের পেশাগত প্রশিক্ষণ ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা, যাত্রীবান্ধব সড়ক পরিবহন আইন ও বিধিবিধান প্রণয়ন, গাড়ির ফিটনেস ও চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
পরিচিতি : সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ-এনডিবি ও মহাসচিব সেভ দ্য রোড/ সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ