শিক্ষায় অর্জন ও অপচয়ের সমীক্ষা জরুরি
এসএসসি ও এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর প্রতি বছরই আমরা শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা বিশেষজ্ঞসহ অনেকের অনেক কথা শুনি। তবে সবাই এখন শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করছেন। আমরাও এ মতের পক্ষে লেখালেখি করছি। তবে গুণগত মান বৃদ্ধির বিষয়টি অধরাই থেকে যাচ্ছে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা তো ছোটখাটো কোনো খাতের বিষয়ে এখন আর নেই। প্রায় পাঁচ থেকে ছয় কোটি মানুষ এর সঙ্গে জড়িত। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী, এর পরের অবস্থানে শিক্ষক ত্রিশ লাখের কম হওয়ার কোনো কারণ নেই। যদিও সঠিক কোনো পরিসংখ্যান সরকারের হাতেও নেই। এরপর আছেন শিক্ষা প্রশাসনে যুক্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারী। পৃথিবীতে অনেক দেশে এত সংখ্যক জনসংখ্যাও নেই। আমাদের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষা সহায়ক জনবল যত আছেন। দেশের শিক্ষা খাতে প্রতি বছর সরকারি বাজেটও বাড়ছে। সরকার যত অর্থ শিক্ষাখাতে ব্যয় করছে তার চাইতে ঢের গুণ বেশি অর্থ অভিভাবকগণ সামষ্টিকভাবে ব্যয় করছেন। দিন দিন সব শিক্ষাই বেশ ব্যয় বহুল হয়ে উঠছে। একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুর জন্য গ্রামেগঞ্জেও অভিভাবকদের বেশির ভাগই এখন কোচিংয়ের নামে যত অর্থ ব্যয় করছেন, আগে তা কল্পনাও করা যেত না। শহরের নামিদামী স্কুলের খরচ অবিশ্বাস্য অংকে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু তারপরও এ কথা মোটেও আস্থার সাথে দাবি করা যাচ্ছে না যে, এসব নামিদামী প্রতিষ্ঠান থেকে বের হওয়া শিক্ষার্থীরাও উচ্চ শিক্ষায় আসতে পারছে, সফল হচ্ছে। এখনো ব্যতিক্রম হিসেবে গ্রাম থেকে কিছু কিছু শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষায় এসে সবাইকে বিস্মিত করে দেয়। তাদের কেউ কেউ জীবনে সফল হন। সামগ্রিকভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ঝরে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত বেড়েই চলেছে। মানহীন শিক্ষা নিয়ে উপরের শ্রেণিতে বা স্তরে যতই উঠছে তাদের বড় অংশই খুব বেশি অগ্রসর হতে পারে না। মানসম্মত শিক্ষা নিয়ে বের হচ্ছে হাতেগোনা শিক্ষার্থী। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা থেকে যত শিক্ষার্থী সনদ হাতে নিয়ে বের হচ্ছে তাদের বেশির ভাগই বিষয়জ্ঞান, দক্ষতা, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চিন্তায় খুব একটা দৃষ্টি কাড়ার মতো মেধা দেখাতে পারছে না। আমাদের বেশির ভাগ তথাকথিত শিক্ষিত শিক্ষার্থী মানসম্মত চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণের তালিকায় আসতে পারে না। একটা ১৫-১৬ গ্রেডের চাকরিতে উচ্চতর ডিগ্রিধারীদের আবেদন করা নতুন কিছু নয়। অসংখ্য ডিগ্রিধারী তরুণ-তরুণী বেকার জীবন-যাপন করেন। কেউ কেউ টুকটাক ব্যবসা-বাণিজ্য ও ফটকাবাজি করে বেড়ান। অথচ বাংলাদেশে দক্ষ মানব সম্পদের অভাব বেড়েই চলেছে। বিদেশ থেকে উচ্চ দক্ষ বিশেষজ্ঞ এনে অনেক প্রতিষ্ঠান চালাতে হচ্ছে। এর মূল কারণ হচ্ছে আমাদের দেশে মানসম্মত কোনো শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো পর্যন্ত গড়ে উঠে নি। যে যার মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলছে, অনুমোদন ও নিয়ন্ত্রণের কোনো বিধান সর্বত্র কার্যকর হচ্ছে না। মেধাবীদের শিক্ষকতার পেশায় টানা হচ্ছে না। বেশির ভাগ মানহীন সনদধারীদের হাতে দেশের শিশুদের পঠন-পাঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা কী পড়াচ্ছি , কেন পড়াচ্ছি, পড়িয়ে কি লাভ হয়- এ সবের খুব যুক্তিসংগত উত্তর নেই। দেশের বেশির ভাগ সব স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই চলছে যেনতেন প্রকারে। পঠন-পাঠনে কোনো মান নেই, শেখা ও শেখানোর দায় নেই। সর্বত্র অনিয়ম, দুর্নীতি আর মানহীন পঠন-পাঠনে ভরা। এমন অবস্থার নাম অপচয় ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। শিক্ষায় আমাদের অর্জনের পরিসংখ্যান নিলে তা কেবলি শুন্যের দিকে ধেয়ে আসবে আর অপচয়ের পরিসংখ্যান নিলে তা কেবলি একশতভাগকে ধরতে বা ছুতে পাল্লা দিয়ে ধেয়ে আসছে বলে মনেহয়। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে অতি অবশ্যই একটি গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতেই হবে, বর্তমানের অব্যবস্থার অবসানও ঘটাতেই হবে। তাহলেই আমাদের প্রতিটি শিশু মেধা ও মননে বেড়ে উঠতে সফল হবে, দেশ ও জাতি মানব সম্পদে উন্নত হবে।
লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, বাউবি