রোজা: ঐক্যের কলতান
মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ : ইসলাম শান্তির ধর্ম। জননিরাপত্তা, মানব-মর্যাদা সেখানে পূর্ণ স্বীকৃত। মানুষের অহংকার, আত্মাভিমান এ ধর্মে নিষিদ্ধ। চরিত্র গঠন ও নৈতিকতা বজায় রাখাই বিধিসম্মত। শিষ্টের পালন ও অশিষ্টের দমন, ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের বিলোপ সাধন, হক ও বাতিলের পার্থক্য নির্ধারণ করে সত্য প্রতিষ্ঠা ও অসত্যের বিনাশ সাধন এ ধর্মের অন্যতম অমোঘ উপাদান। ছোট-বড়, উঁচু-নিচু, সাদা-কালো, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য নেই এ ধর্মে। সমাজের অধম ও ইয়াতিমদের সাহায্য করা, দুঃখী ও মজলুমের ফরিয়াদকে ভয় করা, সহনশীলতা, বিনয়-ন¤্রতা, ধৈর্য ও শিষ্টাচারের অনুশীলন এ ধর্মের নীতি-আদর্শ। প্রিয়নবী (সা.) যুগ যুগ ধরে বিবাদ-কলহে লিপ্ত গোত্রসমূহে বিভক্ত, পরস্পর যুদ্ধরত অজ্ঞ বেদুঈনদের অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। তিনি এক দুর্ধর্ষ উচ্ছৃঙ্খল জাতিকে সুসংহত, সুশৃঙ্খল ও কর্মমুখী এক আদর্শ জাতিতে পরিবর্তিত করেছেন। প্রিয় নবী (সা.) স্বীয় জীবনের আদর্শ, নীতি, আচরণ, ভূমিকা ও ত্যাগের মহিমায় এবং সর্বোত্তম নেতৃত্বের মাধ্যমে তিনি এ কাজে সমর্থ হয়েছিলেন। আল্লাহ প্রদত্ত পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান ও মহানবীর (সা.) প্রদর্শিত পথই মানবতার মুক্তির একমাত্র উপায়। এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা পেতে পারি একটি সুশীল সমাজ ব্যবস্থা।
পবিত্র কোরআনে বিবৃত এবং প্রিয় নবীজীর হাদিসে বিবৃত মুমিনের জন্য অবশ্য পালনীয় বিধানসমূহে সিয়াম সাধনা অন্যতম। এরই মাঝে আমাদের যাবতীয় ভুলভ্রান্তি দূরীকরণ এবং ভবিষ্যৎ সুন্দর সমাজ গঠনের সব উপাদান রয়েছে। সিয়াম সাধনায় ব্যক্তিগত দিক থেকে নৈতিক ও দৈহিক প্রশিক্ষণের প্রভাব যেমন আমাদের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সংশোধন কিংবা জীবাত্মা ও পরমাত্মার সম্পর্কের উন্নতি সাধন অধ্যাত্ম সাধনার পরিশীলন তেমন এর বহিরঙ্গের দিকটিও উপেক্ষণীয় নয়। সিয়াম সাধনায় ব্যক্তিগত শিক্ষার সঙ্গে পরিবার ও গোষ্ঠীগত শিক্ষার মহড়া হয়। একজনের দেখাদেখি অপরজন রোজা পালনে উদ্বুদ্ধ হয়। এভাবে তা বৃহত্তর সমাজে পরিব্যাপ্ত হয়। বস্তুত রমজানে রোজা পালনে আত্মসংযম আত্মশোধনে যোগ্য করে তোলার লক্ষ্যে অধ্যাত্মিক সাধনায় আত্মনিবেদনকল্পে ভাবের তূরীয় মার্গে উন্নীত হওয়ার সাধনা নিহিত। বাস্তবেেত্র জাগতিক ক্রিয়ায় যে মানুষটি পরিহিতে ব্রতী হবে, তার পক্ষে নিজেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তোলাই হবে প্রাথমিক কর্তব্য। সিয়াম বা রোজা আত্মার পবিত্র ওষুধ। সংযমের সাধনা হলো, সিয়ামের সর্বশ্রেষ্ঠ ও প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ সংযমের মাধ্যমে মানুষ পশুত্বের ঊর্ধ্বে উঠে পরম সত্তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ পায়। প্রাত্যহিক জীবনের ধূলি জালের ঊর্ধ্বে আত্মার অনাবিল প্রশান্তি লাভের একমাত্র উপায় সাধনায় সিদ্ধি লাভ। আর সে সাধনার প্রথম সোপান হলো সিয়াম বা রোজা। নিজের ভেতর কলুষ দূরীভূত হলে, সমাজ সংসার থেকে অশান্তি দূর হবে। সমাজ থেকে পরস্পর হানাহানি, হিংসা, বিদ্বেষ ও কলহ মুক্ত হয়ে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সম্ভবপর হবে।
কিন্তু আজ সমাজের প্রতিটি স্তরে সীমাহীন অন্যায়, জুলুম, দুর্নীতি, অবিচার-অনাচার। হিংসা-বিদ্বেষ স্বার্থপরতা মানুষকে হিং¯্র পশুর পর্যায় নামিয়েছে। ধর্ম, নীতিবোধ, ওয়াজ নসিহত সব যেন ভিন গ্রহের অন্য কারো জন্য। নৈতিক অবয়ব, মানবতা ও মূল্যবোধের এ দুর্দিনের শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে আঁকড়ে ধরতে হবে কোরআন ও সুন্নাহকে। সুতরাং মহান রাব্বুল আলামিন এবং প্রিয়নবীর (সা.) নির্দেশিত পথ অনুযায়ী আন্তরিকতার সঙ্গে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে এ দুর্গতি থেকে আমাদের মুক্তি অবশ্যই সম্ভবপর। আর তখনই সমাজে ভেসে উঠবে প্রশান্তির প্রতিচ্ছবি। ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সবাই গাইবে সাম্যের গান- ফিরে আসবে ঐক্যের কলতান। লেখক: শিক্ষাসচিব, বাইতুন নূর মাদ্রাসা, ঢাকা।