সাহিত্যে নারী, নারীর সাহিত্যকর্ম
জুলফিয়া ইসলাম : নিত্যদিনের সাংসারিক কর্তব্য পালন যে কেমন গ্লানিকর ও আত্মঘাতী হতে পারে সে কথাটা রুশ বিপ্লবের পর ১৯১৯-এ লেনিন বলেছিলেনÑ সমস্ত মুক্তিদায়ী আইন সত্ত্বেও মেয়েরা সাংসারিক দাসীই থেকে যাচ্ছে। আইন হয়েছিল, তবু মুক্তি আসেনি, কেন না অর্থনীতি বদলায়নি, আদর্শও রয়ে গেছে অস্পষ্ট। ফলে, লেনিনের ভাষায়, ‘ক্ষুদে সাংসারিক গৃহস্থলি তাকে দাবিয়ে রাখছে, শ্বাসরুদ্ধ করছে, বিমূঢ় করছে, হীন করে রাখছে ক্ষুদ সাংসারিক গৃহস্থলিতে; বেঁধে রাখছে তাকে রন্ধনশালায় আর শিশুপালন ঘরে; অমানুষিক রকমের অনুৎপাদক, তুচ্ছ, পি-ি জ্বালানো মনভোঁতা করা হাড় গুঁড়ানো করে আচরিত হচ্ছে তার শ্রম।’
রবীন্দ্রনাথ অবশ্য মেয়েদেরকেই বিজয়ী করেছেন, ভিন্ন ভিন্নভাবে। প্রিয়া হোক কি মাতাই হোক, অর্ধেক হোক কল্পনা, মেয়েরাই দেখছি জয়ী হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত। উন্মোচিত হয়ে পড়েছে পুরুষের দুর্বলতা, কোথাও কোথাও সামান্যতা। এমনকি অমিত রায়কেও দুর্বল মনে হয় লাবণ্যের পাশে, অমিতের সমস্ত নৈপুণ্য ও ধন-সম্পত্তি সত্ত্বেও। কাজী নজরুল ইসলামের কথা উল্লেখ করেছি, তিনি পুরুষ ও নারীতে বৈষম্যে বিশ্বাস করতেন না, মনে করতেনÑ জগতের যত মহৎ সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর। এবং কাপুরুষরাই কেবল মেয়েদেরকে বন্দী করে রাখে। কিন্তু তিনিও আবার নারীর দুই মূর্তির কথা উল্লেখ করেছেনÑ এক মূর্তি প্রেম দেয় অন্য মূর্তি দেয় যন্ত্রণা। বলার অপেক্ষা রাখে না এই দেখাটা পুরুষেরই দেখা, পুরুষের প্রয়োজনে। রবীন্দ্রনাথও মেয়েদেরকে দুই জাতের বলে মনে করতেন, মাতার ও প্রিয়ার। দৃষ্টিভঙ্গিটা মূলত পুরুষেরই।
এই সত্যটাকেই রবীন্দ্রনাথ অন্যভাবে দেখতে পেয়েছিলেন জাপানে গিয়ে। যে জন্য তিনি বলেছেনÑ পরাধীনতা বড় বন্ধন নয়, কাজের সঙ্কীর্ণতাই হচ্ছে সবচেয়ে কঠোর খাঁচা। রুশ দেশে জারের আমলে বিবাহকে মনে করা হতো পবিত্র, আইনগতভাবে এই বন্ধন ছিন্ন করা চিল অত্যন্ত কঠিন, যে জন্য টলস্টয়ের নায়িকা আন্না কারেরিনাকে পীড়িত ও বিধ্বস্ত হতে হয়েছিল। লেনিন তাই ঘোষণা করেছিলেন, ‘বুর্জোয়া নোংরামি, দলিতাবস্থা ও লাঞ্ছনার যা উৎস বিবাহ বিচ্ছেদের এই মামলাবিধি সোভিয়েত শাসন পুরোপুরি বিলুপ্ত করেছে।
পুরুষ পারে মুক্তি দিতে, কেন না সে হচ্ছে কর্তা কিন্তু সে আবার পারেও না, কেননা না পারাতেই রয়েছে তার স্বার্থরক্ষা। কমলই যদি মেনে নেয় পিতৃতান্ত্রিকতা অর্থাৎ পুরুষতান্ত্রিকতা তবে অন্যরা কেন তা নেবে না? প্রফুল্ল তো নেবেই, প্রফুল্ল অনুশীলনে বিকশিত ঠিকই কিন্তু সে তো দার্শনিক নয়, কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে না প্রচলিতকে মান্য করে চলে।
মাইকেল মধুসূদনের ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকের নায়িকা আত্মহত্যা করেছে। গিতা ভিমসিংহের ক্ষমতা ছিল না একমাত্র কন্যা কৃষ্ণকুমারীকে রক্ষা করে। দুই দিকের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী নৃপতি কৃষ্ণকুমারীকে হস্তগত করতে চায়, তারা তাকে ছিনিয়ে নেবে। কৃষ্ণকুমারী দেখল বাঁচার একমাত্র উপায় হচ্ছে আত্মহত্যা করা। সেটাই সে করেছে। মরে গিয়ে বেঁচে গেছে।
প্রফুল্ল কাহিনী বঙ্কিমচন্দ্র শেষ করেছেন একটি সম্পাদকীয় মন্তব্য দিয়ে, ‘এখন এসো প্রফুল্ল। একবার লোকালয়ে দাঁড়াও আমরা তোমায় দেখি। একবার এই সমাজের সম্মুখে দাঁড়াইয়া বল দেখি, আমায় ভুলে গেছ, তাই আবার আসলাম।’ কেবল আসে না, থাকে; তাকে আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত করে, বিভাজন ও বৈষম্যের মধ্য দিয়ে সমর্থন জানিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে রাখার চেষ্টা নেওয়া হয়। নারীর কাজ গৃহে, তার মুক্তি পুরুষের সহৃদয়তায়, এই তত্ত্ব আজ যে অপ্রচলিত তা তো নয়।
প্রফুল্লের ঘটনাটাও আসলে আত্মহত্যাই কিন্তু এই আত্মহত্যায় কৃষ্ণকুমারী মৃত্যুর বীরত্ব নেই, প্রফুল্ল বরঞ্চ বাঁচতে গেয়েই মারা গেল। পিতার ব্যর্থতা ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে অত্যন্ত প্রকট এবং তা যেন পরাধীন ভারতবর্ষেরই ব্যর্থতা কন্যাকে রক্ষা করার। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ও পিতার ব্যর্থতারই মহাকাব্য। সন্তানের মৃত্যু ঘটে পিতার পাপে; পিতা যতই দুঃখ করুক সন্তান তো আর ফিরে আসবে না। তবে অগ্রসর মধুসূদনের সংস্কৃতিতেও স্ববিরোধিতা রয়েছে। তার ভাষা সংস্কৃতবহুল, অত্যন্ত পিতৃতান্ত্রিক।
শরৎচন্দ্রের নায়িকাদের মধ্যে সবচেয়ে জিজ্ঞাসু ও মুখর হচ্ছে ‘শেষ প্রশ্নের’ কমল। মেয়েটি রূপসী, তার মা বাঙালি বাবা ইংরেজ; তার প্রথম স্বমী আসমীয় খ্রিস্টান। ওদিকে প্রবীণ আমু বাবু হলেন প্রচীন ঐতিহ্যের প্রতিনিধি। তার মনোভূমিতে বিরাজ করছে তপোবনের আদর্শ। দুজনের মধ্যে আর্দশিক বিরোধটা একেবারেই মৌলিক কিন্তু কমল টিকে থাকতে পারে না, আশু বাবুর আদর্শের কাছে সে নতি স্বীকার করে। তাই দেখা যায়, ‘আমু বাবু গাড়িতে উঠলে কমল হিন্দু-রীতিতে পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিল। তিনি মাথায় হাত রাখিয়া আর একবার আশীর্বাদ করিলেন।’ এক ফাঁকে কমল তার এই বিশ্বাসের কথাটাও বলেছে যে, ‘নারীর মুক্তি আজও পুরুষরাই দিতে পারে। দায়িত্ব তো তাদেরই। পিতার অভিশাপের মধ্যে তো সন্তানের মুক্তি থাকে না, থাকে তার অকুণ্ঠ আশীর্বাদের মধ্যেই।’
শ্রীকান্তের কাছে রাজলক্ষ্মীর সেই প্রশ্নটি খুবই মর্মস্পর্শী যাতে সে জিজ্ঞেস করছে, ‘পুরুষ মানুষ যতই মন্দ হয়ে যাক, ভালো হতে চাইলে তো কেউ বাধা দেয় না কিন্তু আমাদের বেলায়ই সব বন্ধ কেন? প্রশ্ন করে বটে কিন্তু আবার মেনেও নেয়। রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্তকে যতœ করে খাওয়ায় এবং তার পদধূলি নেয়। শ্রীকান্তের অনেক ঘোষণার মধ্যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ‘নারীর চরম স্বার্থকতা যে মাতৃত্বে এ কথা বোধ করি গর্ব করিয়া প্রচার করা যায়।’ এই বক্তব্যকে শরৎচন্দ্রের কথাসাহিত্যিক জগতে নানাভাবে মান্য করা হয়েছে। যে রাজলক্ষ্মী প্রশ্ন করে সেই আবার পুরুষের বিশেষ অধিকারে বিশ্বাস করে।
কিরণময়ী ঠাকুর দেবতায় আস্থা রাখে না,পুরুষকে মনে করে খেলার পুতুল কিন্তু তার পরিণতি কী? পরিণতিটা মস্তিষ্ক বিকৃতি। সরোজিনী ইঙ্গবঙ্গ সমাজের মানুষ কিন্তু সে দেখা গেল উন্নতি করছে। একদিন যখন তাদের বাড়ির উঠানে একটি বৃহদায়তন চারুদর্শন রোহিত এনে ফেলা হলো তখন প্রশ্ন উঠল মাছটি কুটবে কে? মাতা পারবেন না, সেদিন তার একাদশী। এখন সরোজিনী এলো এগিয়ে বসল বাঁটি নিয়ে এবং কুটল ওই মাছ। মা আশীর্বাদ করে বললেন, ‘যেই ওই আঁশ-হাত চিরকালের জন্য অক্ষয় হয়।’ হবে, সরোজিনী হাত অক্ষয় হবে, যেমন আরও অনেকের হাত হয়েছে। সে জানবে, যেমন রাজলক্ষ্মী জেনেছে, ‘খাওয়া বস্তুটা যে হিন্দু ধর্মের কি এবং সমাজের কতখানি ইহার উপর নির্ভর করে।’
তবে বাস্তব অবস্থা এই রকমের যে, স্বামী-স্ত্রী যে একসঙ্গে আহারে বসবে সে উপায় ছিল না। বসলে বলা হতো লজ্জাহানি কাজ করা হচ্ছে। মধ্যযুগে এই প্রথা চালু ছিল যে, গৃহস্বামী স্ত্রীর সঙ্গে একত্রে আহার করতে পারবে না এই শঙ্কায় যে তাতে স্বামীর পৌরুষের হানি ঘটবে। নিশ্চয়ই আগের ব্যবস্থাও ওই রকমেরই ছিল। তাই মাছি থাকুক বা না থাকুক স্ত্রীর পক্ষে পাখা নাড়ানো ছাড়া উপায় কী! কিন্তু আধুনিককালে এসেও যে তাকে আদর্শায়িত করা হয়েছে তাতে বোঝা যায় পূর্ব সংস্কার সহজে ঘোচে না এবং প্রতিষ্ঠিতকে মঙ্গলময় নয় কেবল, সুন্দর বলে মেনেও নেওয়া হয়।
লেখক: কথাসাহিত্যিক