উত্তর ও দক্ষিণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রেক্ষাপট
ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ : সত্তরের দশকে এসে বিশ্বের বিবেকবান মানুষ নতুন করে উপলব্ধি করে যে ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের ক্রমঃপ্রসারমান চিত্র পৃথিবীর ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে না। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ উন্নয়নের উপর অনুষ্ঠিত এক বিশেষ অধিবেশনে তাই ‘নয়া আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা’র ঘোষণা গ্রহণ করে। ন্যায়সঙ্গত ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিশ্ব অর্থনৈতিক সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের উদ্দেশ্যে গৃহীত এ ঘোষণার লক্ষ্যসমূহ হচ্ছেÑ উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশসমূহের মধ্যে ক্রমঃপ্রসারমান অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরোধ এবং বিশ্ব পর্যায়ে সুস্থির আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নিশ্চয়তা প্রদান।
নয়া আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বাস্তবায়ন আরও ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে রাষ্ট্রসমূহের অর্থনৈতিক অধিকার ও দায়িত্ব বিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ সনদ গৃহীত হয়। এই সনদে প্রত্যেক দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা নির্ধারণে সেই দেশের জনগণের সার্বভৌম ইচ্চার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
ভূমিকায় এ কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, উন্নয়নের সুফল সকলের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে বন্টন করতে হবে। এতে অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করা হয়েছে যে জাতিসংঘ ঘোষিত নাগরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার অর্জনে বাধা প্রদান ‘উন্নয়ন’ এর ক্ষেত্রে গুরুতর প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ; কেননা সমস্ত মানবাধিকারই একক, অবিভাজ্য ও পরস্পর নির্ভরশীল। এই ঘোষণাপত্রে এ কথাও বলা হয়েছে যে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা হচ্ছে উন্নয়নের অপরিহার্য উপাদান। ঘোষণাপত্রে নিরস্ত্রীকরণকে উন্নয়নে সম্পদ প্রাপ্তির একটি উপায় হিসেবে বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে এভাবে প্রাপ্ত সম্পদ বিশেষত উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে নিবেদিত হতে পারে। ভূমিকাংশে মানুষকে ঘোষণা করা হয়েছে উন্নয়নের ‘মূল বিষয়’রূপে এবং বলা হয়েছে যে মানুষই উন্নয়নে প্রধান অংশগ্রহণকারী এবং প্রধান ফলভোগকারী। এই উন্নয়নের অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টির প্রাথমিক দায়িত্ব রাষ্ট্রসমূহের।
জাতিসংঘ একদিকে যেমনি ধনী ও দরিদ্র দেশের বিত্তবান ও বিত্তহীনদের মধ্যকার ব্যবধান কমিয়ে আনার প্রয়াস চালাচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি বিভিন্ন দেশের মধ্যকার বিত্তবান ও বিত্তহীনদের মধ্যকার ব্যবধান হ্রাসেরও প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেই লক্ষ্যে জাতিসংঘ শিল্পসমৃদ্ধ দেশের গরীব ও বঞ্চিতদের অবস্থা উন্নয়নেও প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আর তা পরিচালিত হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদী এক নীতিমালার আওতায়Ñ যার লক্ষ্য হচ্ছে বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও সংঘাতের মাত্রা হ্রাস।
উন্নয়নশীল দেশগুলো যাতে বিশ্ব অর্থনীতিতে তাদের যথাযথ স্থান পেতে পারে, সে জন্যে সাধারণ পরিষদ ধারাবাহিকভাবে বিশ্ব অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে আসছে। বস্তুতপক্ষে ১৯৬১ সালের পর থেকে জাতিসংঘ একটানা ১০ সাল বা দশকওয়ারি উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করে এসেছে। এতে ধনী ও দরিদ্র দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ব্যবধান কমিয়ে আনার নিমিত্তে সাধারণ পরিষদ, সরকারসমূহ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের তৎপরতার মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর নানাবিধ সুপরিশ পেশ করে এসেছে।
১৯৭৪ সালে সাধারণ পরিষদ উত্তর-দক্ষিণের মধ্যে ক্রমসম্প্রসারমান অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনার উদ্দেশ্যে ‘নয়া আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (ঘওঊঙ)’-র ঘোষণা ও কর্মসূচি গ্রহণ করে। নববিধানে শিল্পসমৃদ্ধ দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সরকারি সাহায্যের একটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় যা সাহায্যদাতা দেশের বার্ষিক মোট উৎপাদনের ০.৭ শতাংশের কম হবে না। কোনো কোনো দেশ যেমন ডেনমার্ক, হল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন বাস্তবেও এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেছে এবং গত দুই দশক ধরে এই লক্ষ্যমাত্রার আলোকেই উত্তর-দক্ষিণ সম্পর্ক যাচাই করা হয়েছে এবং হচ্ছে।
লেখক, কলামিস্ট ও গবেষক
ভড়ৎয়ধহ.রহভড়@মসধরষ.পড়স