রাজধানীতে বাড়িভাড়া অতঃপর মানসিক নির্যাতন
প্রকৌশলী নওশাদুল হক
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কর্মহীনতা কিংবা কর্মস্থল, উন্নত চিকিৎসা এবং উচ্চশিক্ষা গ্রহণই মূলত গ্রামের মানুষগুলোকে ক্রমশঃ শহরমুখী হতে বাধ্য করে। আর গ্রাম হতে শহরে এহেন মাইগ্রেশনের বেশির ভাগ চাপই পড়ে রাজধানীর বুকে। রাজধানীতে আয়তনের তুলনায় অধিক জনগোষ্ঠীর চাপ কারও কারও জন্যে অভিশাপ আবার কারও কারও জন্যে আশির্বাদও বটে!
আশির্বাদের তালিকায় সর্বাগ্রে রাজধানীর বাড়ীওয়ালারা। মক্কেলের অভাব না থাকায় তারা হাতিয়ে নিচ্ছে অত্যাধিক ভাড়া সাথে মোটা অংকের অগ্রিম। বাসাভাড়ার চুক্তির পূর্বে অসংখ্য সুবিধাদির কথা স্বীকার করলেও বাসাটি হস্তান্তরের ক’দিন পর হতেই শুরু হয় নানামুখী বিড়ম্বনা। চাহিদামত পানি সরবরাহ না করা এদের অন্যতম। পানি, গ্যাস এবং বিদ্যুতের লাইন ও পানির মোটরে নিয়মিত সমস্যা। নিম্ন মানের স্যানিটারি ও বৈদ্যুতিক ফিটিংস সমৃদ্ধ বাসায় দুদিন পর পরই ভাড়াটিয়া নিজ দায়িত্বে মিস্ত্রি ডেকে মালামাল সরবরাহ ও প্রতিস্থাপন। দারোয়ানের পরিবর্তে গেইটে তালা। অনুমোদনহীন বা নক্সা বহির্ভূত বাড়ী তৈরির ফলে থাকে না পর্যাপ্ত আলো বাতাসের সুবিধা কিংবা অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা। গাড়ী পার্কিংয়ের ব্যবস্থা না রাখায় বাড়ীর সামনের রাস্তায় গাড়ী পার্কিং, অতপরঃ যানজট! একই বাড়ীতে অনেকগুলো ইউনিটে ফ্যামিলি এবং ব্যাচেলর উভয় ধরনের ভাড়াটিয়ার সংমিশ্রনের ফলে মাঝে মধ্যেই দেখা দেয় বিভিন্ন রকম সামাজিক সমস্যা। অনেকক্ষেত্রে বাড়ীওয়ালা উচ্চভাড়া কিংবা নিজের যৌনতার উদ্দেশ্যে দু’একটি ইউনিটে অনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে সম্পর্কিত ভাড়াটিয়ার হাতে তুলে দেয় বাসার চাবি। ভাড়াটিয়ার ছাদ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা এবং নির্দিষ্ট সময়ে ভাড়া পরিশোধ করতে ব্যার্থ হলেই বাড়িওয়ারার উচ্চবাচ্য ও নানা রকম দুর্ব্যবহার। সাথে সাথে বাড়িওয়ালার মোড়লগিরিতো প্রতিনিয়তই চলমান। অনেকক্ষেত্রে কর্তাবিহীন বাসায় স্ত্রী’র উপড় পাশবিক নির্যাতনও চালায় কোন কোন প্রভাবশালী ও লম্পট বাড়িওয়ালা। ফলে উক্ত বাড়ির অন্য ভাড়াটিয়াদের সামাজিক বিপত্তির আর কোন অন্ত থাকেনা। ভাড়াটিয়াদের এহেন অভিযোগের প্রেক্ষিতে বাড়িওয়ালাদের সোজাসাপ্টা উত্তর-”পছন্দ না হলে বাড়ী ছেড়ে চলে যেতে পারেন”। বাড়ি ছাড়তে বলা একজন বাড়িওয়ালার পক্ষে যতটা সহজ, একজন ভাড়াটিয়ার পক্ষেতো ততটা সহজ নয় নিশ্চই! নিজের কর্মস্থল এবং সন্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবস্থানের কথা বিবেচনা করে ভাড়াটিয়াকে মুখ বুঝে সহ্য করতে হয় বাড়িওয়ালাদের এহেন মানসিক নির্যাতন। রাজধানীর বাড়িওয়ালারা স্বাভাবিক ভাবেই সামাজিক, অর্থনৈতিক, আঞ্চলিক ও সর্বোপরি রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী। ফলে অগ্রিম নোটিশ এবং সম্পাদিত এগ্রিমেন্টের শর্তাবলীর তুয়াক্কা না করেই কিছুদিন পরপরই বাড়িয়ে দেয় বাড়িভাড়া। এদেশে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন বিদ্যমান থাকলেও তা একদমই অকার্যকর। উচ্চহারে বাসাভাড়া আদায়কারী বাড়িওয়ালাদের টেক্স ফাঁকির ফলে সরকার হারাচ্ছে মোটা অংকের রাজস্ব। আর ভাড়াটিয়ারা হারাচ্ছে তাদের অর্থনৈতিকও সামাজিক অবস্থান এবং মানসিক শান্তি।
ভাড়াটিয়াদের হারানো এহেন মানসিক শান্তি ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় বিষয়ভিত্তিক মনিটরিং কমিটি। সবচেয়ে বেশি যেটির প্রয়োজন তাহলো সামাজিক সচেতনতা। বাড়ীভাড়া নিয়ন্ত্রন আইনকে করতে হবে আরও সমৃদ্ধশালী এবং অনেক বেশি কার্যকর। আর তবেই ভাড়াটিয়াদের উপর বাড়িওয়ালাদের মানসিক নির্যাতন কিছুটা হলেও হ্রাস করা সম্ভব।
পরিচিতি: সভাপতি, ঢাবি সমাজকল্যাণ অ্যালামনাই ফোরাম/সম্পাদনা: নৌশিন আহম্মেদ মনিরা