শিশুদের বাসযোগ্য পৃথিবী
মেজর ডা. খোশরোজ সামাদ
১। প্রায় তিনশ বছর আগে কবি ভারত চন্দ্র রায়গুণাকর রচনা করেন অমর কবিতা ‘আমার সন্তান ‘। নীচে কবিতাটির গদ্যরূপ দেওয়া হল ।
২। দেবী অন্নপূর্ণা মানবীর রূপে নদীর ঘাটে আসেন । মাঝি তাকে পার করবার সময় দেখে সেঁউতি ( যে পাত্র দিয়ে নৌকার পানি সেঁচা হয় ) যাত্রীর ছোঁয়ায় সোনা হয়ে গেছে। মাঝি বুঝতে পারে আরোহী মানবীরূপী কোন দেবী । তুষ্ট অন্নপুর্ণা তখন নিজ পরিচয় দিয়ে ‘বর’ দিতে চান । দরিদ্র মাঝি নিজের জন্য কোন কিছু না চেয়ে শুধু সন্তানের কল্যাণের কথা ভেবে গভীর মমতা নিয়ে বর চাইলেন ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে ।’
৩। যে কোন উৎসবের আনন্দে সন্তানের আনন্দের মাঝেই বাবা-মা তাঁদের আনন্দ খুঁজে পান। স্বল্প আয়ের পরিবারের একজন উপার্জনক্ষম মানুষ নিজে ঈদে কোন কাপড় দিতে না পারলেও সন্তানকে সাধ্য অনুযায়ী ভাল পোষাক দিতে চেষ্টা করেন । নিজেকে লুকানোর জন্য মিছে করে বলেন ‘আমার যথেষ্ট জামা-কাপড় আছে । ‘নিজে না খেয়েও সন্তানের মুখে ভাল-মন্দ তুলে দেবার চেষ্টা করেন ।
৪। শিক্ষার আকাশচুম্বী খরচ মেটাতে বাবা-মা সব সাধ আহ্লাদ বিসর্জন দেন । প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া-আসার জন্য প্রাইভেট কার/উবার /সি এন জির খরচ খুবই অল্প অভিভাবকের আছে । তাই লাখো শিশুকে স্কুলে পাঠাতে বাস-টেম্পো গণপরিবহনের উপরই ভরসা করতে হয় । এইসব গণপরিবহনের অনেকগুলোরই রুট পারমিট, ফিটনেস নেই। গাড়ির ইঞ্জিন, সাসপেনসন এমনকি ব্রেক – এ রয়েছে ভয়াবহ সমস্যা। কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের রোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পর জীবন বাজি রেখে বাদুরঝোলা করে স্কুল যেতে-আসতে হয় । গাদাগাদি করে ধারণক্ষমতার চেয়ে বহুগুণ যাত্রীকে মুড়ির টিনের মত বদ্ধ করে রাখা যেন তাদের ‘ টহৎিরঃঃবহ জরমযঃ’! বাসের কনট্রাক্টরের দুর্ব্যবহার , ধাক্কা দিয়ে স্টপেজ ছাড়াও তাদের সুবিধামত জায়গায় নামিয়ে দেয়া , ইট দিয়ে থেতলে দেয়া , নানা অছিলায় ছাত্রীদের শরীরে হাত দেয়া, চলন্ত বাসে ধর্ষণ —— কি করে না এই দুর্বৃত্তরা!! নেশা-ভাং না করলে এদের ‘ড্রাইভিং জোশ’ আসে না ।
৫। বিকল্প না থাকায় অভিভাবকরা এদের হাতেই সন্তানদের তুলে দিয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে না আসা পর্যন্ত উৎকণ্ঠায় কাটান প্রতিটি ক্ষণ। প্রায় প্রতিদিনই প্রকাশিত -লুকিয়ে ফেলা ‘দিয়া’ দের রক্তমাখা লাশ আমাদের স্বপ্ন কেড়ে নিচ্ছে।
৬।কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর ‘ ছাড়পত্র ‘ কবিতায় তীব্র আশাবাদী কণ্ঠে বলেছিলেন ‘ এ পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, তারপর হব ইতিহাস’ । তিনি প্রায় কৈশোর পেরনো বয়সে, বহু বছর আগেই, অনলোকে যাত্রা করে ইতিহাস হয়ে আছেন । সেই অনন্ত নক্ষত্র বীথি থেকে তিনি কি সত্যি এই পৃথিবীকে ‘শিশুদের বাসযোগ্য’ দেখতে পাচ্ছেন?
লেখক: উপ-অধিনায়ক, আর্মড ফোর্সেস ফুড এন্ড ড্রাগস ল্যাবরটরী/সম্পাদনা: মোহাম্মদ আবদুল অদুদ