চালের দাম বাড়লেও লাভ নেই কৃষকের
মাসুদ মিয়া: চালের দাম ৪০ টাকা হলেও কৃষকের তেমন কোন লাভ হচ্ছে না। কৃষক প্রতি মণ ধান বিক্রয় করছে ৮০০ থেকে ১০০ টাকা। এক বিঘা জমিতে কৃষকের খরচ হয় ১০ হাজার টাকা ততে ২০ থেকে ২৫ মণ ধান হয়। এদিকে সাধারণ ক্রেতারা মনে করেন, সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে চালের দাম ৩০ টাকা হওয়া উচিত। চালের দাম ৪০ টাকা হলেও কৃষকের লাভ নেই। ধান থেকে চাল উৎপাদন এবং সে চাল ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর আগে পাঁচ ধরনের মধ্যস্বত্বভোগীর হাত ঘুরে আসে। এসব মধ্যস্বত্বভোগীর পকেটে যায় চালের দামের ৪০ শতাংশ।
বাজার পর্যবেক্ষকরা বলেন, এবার যেখানে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে খরচ করতে হয়েছে ১৫ থেকে ১৬ টাকা; সেখানে সেই ধান ২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে। কেননা বর্তমান বাজারে চড়া দরে চাল বিক্রি হচ্ছে। এ হিসেবে ধান থেকে চাল উৎপাদন ও বিপণনের প্রক্রিয়ায় দামের বড় অংশই মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে ঢোকানোর বন্দোবস্ত করা হয়েছে। এদিকে বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে বানিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, চালের দাম কেজিতে ৪০ টাকার নিচে আর নামবে না। দাম ৪০ টাকার নিচে না নামার পক্ষে যুক্তি দিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘চালের বাজারদর এখন স্বাভাবিক। কৃষকের দিকটিও তো খেয়াল রাখতে হবে। চালের দাম যখন কম ছিল, তখন সাংবাদিকেরা লিখেছেন যে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটা ঠিক কৃষককে গুরুত্ব দিতে হবে। দাম না পেয়ে কৃষক যদি চাল উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, তাহলে আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হব। এতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ফের হুমকির মুখে পড়বে। পাশাপাশি ভর মৌসুমেও চালের দর আগের মতোই চড়া থাকবে বলে বাজার-সংশ্লিষ্ট অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
বাজারে মোটা চাল (স্বর্ণা-চায়না ইরি) প্রতি কেজি ৪২ থেকে ৪৬ টাকা, পাইজাম-লতা ৫২ থেকে ৫৫ টাকা, মাঝারি মানের চাল ৪৮ থেকে ৫৫ টাকা, নাজির-মিনিকেট ৬০ থেকে ৬৫ টাকা এবং সরু চাল ৫৮ টাকা ৬৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
মিল মালিকরা জানান, এক মণ ধানে সর্বোচ ২৭ কেজি চাল পাওয়া যায়। সে হিসেবে সরকার নির্ধারিত ধানের দর অনুযায়ী প্রতি কেজি চালের দাম হবে ৩৮ টাকা। অথচ বাজারে এ দামে সর্বনিন্মমানের চালও নেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে চালকল মালিক সমিতির একজন নেতা বলেন, ‘আমরা লাভের জন্য ব্যবসা করি, লোকসানের জন্য নয়।
এদিকে ঢাকায় রিকশা চালান কামাল হোসেন, বাড়ি জামালপুরে। তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ি এলাকায় থাকেন। তিন সন্তান, স্ত্রীসহ পাঁচজনের সংসার। রিকশা চালিয়ে প্রতিদিন আয় করেন সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা। প্রতিদিন বাড়ি ফেরার সময় তিন কেজি চাল কিনতে হয় মোনাহারকে। ওই চালের পেছনেই তাঁর খরচ হয় ১৩০ টাকা। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে চাল কিনছিলেন মামুন হোসেন। তিনি জানান, মোটা চাল কেনেন তিনি। এর দাম এখন প্রতি কেজি ৪২ টাকা। বাজারে সবচেয়ে কম দামের চাল এটাই! গার্মেন্টস কাজ করেন মারুফ হোসেন বলেন। মাসে আয় করেন ৮ হাজার টাকা। তিনি জানান, আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়। মাস শেষে হাত পাততে হয় অন্যের কাছে।
সংসারের জন্য প্রতিদিন দুই কেজি চাল কেনেন। আর চালের পেছনেই খরচ হচ্ছে প্রতিদিনের আয়ের সবচেয়ে বেশি অংশটা। বাকি কিছু থাকলে তা দিয়ে সবজি বা মাছ হয়।
কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, রাজধানীতে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়। মাঝে মাঝে দু-এক টাকা কমে আবার বাড়ে। কিন্তু গড়ে বাজারে সবচেয়ে কম দামি চালের দাম ৪০ টাকা। ব্যবসায়ীরা জানালেন, রাজধানীর নিন্ম আয়ের মানুষ ওই চালই কেনেন। কারওয়ান বাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী সারোয়ার আলম বলেন, ‘চালের বর্তমান যে দাম সেটা সরকার চাইলে কমাতে পারে। একটা সিন্ডিকেট আমাদের চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এ সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে পারলে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকে।’
এবিষয়ে চাদপুর, কচুয়ার সার ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দীন মোল্লা বলেন, এখন সরকার সারে আর আগের মতো ভতুর্কি দেয় না। তিনি বলেন, সরকারের নির্ধরিতোর মুল্যর চেয়ে আরও ২০০ টাকা বেশিতে বস্তা সার কিনতে হয়। তিনি বলেন, চালের দাম বাড়লে কৃষকের চেয়ে সিন্ডিকেটদের লাভ বেশি।
‘প্রয়োজন সরকারের মনিটরিং’
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং ওনার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুর রশিদ বলেন, ‘আমাদেরকে গত মৌসুমে বেশি দামে ধান কিনতে হয়েছে। তাই চালের দাম একটু বাড়িয়েছি। প্রতি কেজিতে স্বর্ণা চালে ১ টাকা ৫০ পয়সা এবং মিনিকেট ৫০ পয়সা করে বাড়িয়েছি। তবে অন্য সকল চাল আগের দামে আছে।’
আবদুর রশিদ বলেন, ‘যারা বাজারে অস্বাভাবিক দাম বাড়ায়, তাদের ব্যাপারে সরকার চাইলে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। প্রয়োজনে সরকার বাজার মনিটরিং করতে পারে। তাহলে আসল তথ্য জানা যাবে।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘গরিব মানুষের জন্য দাম বাড়ানোটা কোনোভাবেই যৌক্তিক না। চালের দাম বাড়ানোর কোনো কারণ এখন নেই।’
গোলাম রহমান আরো বলেন, ‘দিন দিন এসব মানুষ নিজের পরিবার চালাতে হাঁপিয়ে উঠছে। এ বিষয়ে সরকারের নজর দেওয়া দরকার।
চালের বাজার নিয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ‘দ্য ট্রান্সফরমিং অব রাইস ভ্যালু চেইন ইন বাংলাদেশ অ্যান্ড ইন্ডিয়া: ইমপ্লিকেশন ফর ফুড সিকিউরিটি’- শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ধান-চালের দাম নির্ধারণে মধ্যস্বত্বভোগীদের এক”ছত্র আধিপত্যের ফলে দেশের ধান উৎপাদনে নিয়োজিত কৃষকরা যেমন ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত, তেমনি বেশি দামে চাল কিনে ভোক্তাদের নাভিশ্বাস উঠছে। গবেষণায় বলা হয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের মধ্যস্বত্বভোগীরা মুনাফা করছেন অতিমাত্রায়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অটোরাইস ও হাসকিং মিল মালিক সমিতির নেতারা বলেন, তারা সরকার নির্ধারিত দামেই ধান কিনেন। তবে তা সরাসরি আড়তদারদের কাছে চাল বিক্রি করেন না। এখানে মধ্যস্বত্বভোগী ফরিয়া আছে। তারাই ট্রাক ভাড়াসহ আনুসঙ্গিক খরচের দোহাই দিয়ে দাম বাড়িয়ে দেয়। অথচ সব দোষ পড়ে মিলারদের ঘাড়ে।