লোকসানের ভয়ে বর্ষা মৌসুমে পেয়ারা নিচ্ছেন না বাণিজ্যিক চাষিরা
মতিনুজ্জামান মিটু: ফলন প্রচুর, তবে দাম নেই। লোকসানের ভয় বা বেশি লাভের আশায় বাণিজ্যিক চাষিরা তাদের গাছে বর্ষা মৌসুমে পেয়ারা নিচ্ছেন না। বেশ কয়েক বছর হয়েছে বাণিজ্যিক চাষিরা বারোমাসি জাত থাই পেয়ারার চাষ করছেন। এই জাতের গাছে ইচ্ছামতো বছরের যে কোনো সময়ে ফল ধরানো বা নেয়া যায়। আবহমান বাংলায় পেয়ারা উৎপাদনের চিরায়ত সময় বর্ষাকাল। এসময় ঝালকাঠির স্বরূপকাঠিসহ দেশের বাজারগুলো পেয়ারায় ভরে ওঠে, পড়ে যায় দাম। বেশ কয়েক বছরের মতো চলতি বর্ষা মৌসুমেও বাজারে পেয়ারার দাম নেই।
স্বরূপকাঠি, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বেশি উৎপাদনকারি এলাকার বাজারগুলোতে কেজি প্রতি পেয়ারা বেচা-কেনা হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকায়। রাজধানী ঢাকার খুচরা বাজারেও ক্ষেত্র বিশেষে কেজি প্রতি পেয়ারা ৩০টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নাটোরের ফল চাষি সেলিম রেজা বলেন, অভিজ্ঞ বানিজ্যিক চাষিরা এখন আর বর্ষা মৌসুমে গাছে পেয়ারা রাখেন না। কারণ এসময়ের পেয়ারায় দাম পাওয়া যায়না। তার ওপর পোকার আক্রমণ এবং বীচি শক্ত হওয়ায় চাষ করে পোষান যায় না, ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। থাই জাতের গাছে ইচ্ছামত যে কোনো সময়ে ফল নেয়া যায়। শীতকালে পেয়ারা জন্মালে দাম বেশি পাওয়া যায়। তখন কেজি প্রতি পেয়ারা ৮০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হয়। আর সে সময়কার পেয়ারায় বীচি শক্ত হয়না এবং মিষ্টি ও সুস্বাদু থাকে। আমরা যারা বানিজ্যিকভাবে চাষ করি তাদের গাছে এখন গুটি পর্যায়ের পেয়ারা ঝুলছে। যা সেপ্টেম্বর থেকে আগামী এপ্রিল পর্যন্ত বাজারে পাওয়া যাবে। বর্ষার সময়ে আমরা গাছে পেয়ারা নেইনি। কৃষিবিদ নাটোরের গোলাম মাওলা বলেন, এখন অনভিজ্ঞরা ছাড়া কোনো অভিজ্ঞ চাষি বর্ষা মৌসুমে গাছে পেয়ারা রাখেন না। বর্ষাকালে সব ধরণের পেয়ারা হয়, দাম পড়ে যায়। কাজী পেয়ারার চাষ লাভজনক নয়, এ জাতের পেয়ারা বর্তমানে বিলুপ্ত হতে চলেছে। এখন থাই-৫ ও থাই-৩ জাতের পেয়ারা বানিজ্যিকভাবে চাষ হয়ে থাকে। মানুষের খাবার টেবিলে যায়গা পাওয়ায় বর্তমানে দেশের আভ্যন্তরিন বাজারে পেয়ারার চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে।
অভিজ্ঞ কৃষক, প্রশিক্ষণ, প্রয়োজনীয় ঋণ সুবিধা ও কাংখিত বাজারের অভাবে শুরু না হতেই হুমকির মুখে পড়েছে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় পেয়ারার বাণিজ্যিক চাষ। কৃষিবিদ ও অভিজ্ঞ ফল চষিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বিরুপ পরিস্থিতিতে বিগত ৫ থেকে ৬ বছরে পুঁজি হারিয়ে পেয়ারা চাষ থেকে ঝরে পড়েছে দেশের দুই হাজারেরও বেশী উদ্যোক্তা।
পেয়ারা হাবিব নামে পরিচিত নাটোর জেলার বনপাড়ার মো. হাবিবুর রহমান বলেন, আমি ৪০ বিঘা জমিতে পেয়ারা আবাদ করে খুব একটা লাভের মুখ দেখিনি। পেয়ারা খুবই স্পর্শকাতর এবং জটিল চাষ। যথেষ্ট অভজ্ঞতা, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রির ব্যবস্থা করা না গেলে শুধুমাত্র অভ্যন্তরিন বাজারের ওপর ভর করে পেয়ারা চাষে কাংখিত সাফল্য অর্জন হবেনা।
লিচু কেতাব হিসেবে পরিচিত পাবনার সফল ও পুরস্কারপ্রাপ্ত ফল চাষি কেতাব মন্ডল বলেন, জমির ইজারা, সার, কীট নাশক, শ্রমিকসহ বিভিন্ন খাতে বিঘা প্রতি পেয়ারা আবাদের জন্য খরচ হয় ১লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা। পেয়ারা উৎপাদন হয় ১০০ থেকে ১৫০ মণ। উৎপাদিত পেয়ারার শতভাগ সব সময় বিক্রি হয়না। অনেক সময় অর্ধেক এবং ক্ষেত্র বিশেষে আরো বেশী পেয়ারা বিক্রির অভাবে পঁচে নষ্ট হয়। এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশে উৎপাদিত পেয়ারা আভ্যন্তরিণ বাজারেই বিক্রি করতে হয়।
বাংলাদেশের মাটির উর্বরতার কথা বিবেচনায় এখানে প্রচুর পরিমাণে পেয়ারা আবাদ করা সম্ভব। আবাদ করে পেয়ারার পাহাড় বানিয়ে ফেলা যায়। কিন্তু রপ্তানীমুখি করা না গেলে পেয়ারা আবাদে কোনো সাফল্য টেকসই হবেনা। রপ্তানি হলে বাংলাদেশ থাই পেয়ারাসহ উন্নত জাতের পেয়ারায় ভরে যাবে।