একমাসে শেয়ারবাজার ছেড়েছেন দেড় লাখ বিনিয়োগকারী
ফয়সাল মেহেদী: অনিশ্চয়তা কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের। ২০১০ সালের ধসের পর আজও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি পুঁজি হারানো বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী। আশার আলো না দেখে হতাশায় শেয়ারবাজার ছাড়ছেন তারা। শুধু চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসেই(জুলাই’১৮) দেড় লাখেরও বেশি বিনিয়োগকারী তাদের বেনিফিশিয়ারি ওনার্স বা বিও হিসাব বন্ধ করে শেয়ারবাজার ছেড়েছেন। এর আগে গত তিন অর্থবছরে শেয়ারবাজার ছেড়েছেন সোয়া চার লাখেরও বেশি বিনিয়োগকারী।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না দেশের শেয়ারবাজার। দেশের অর্থনীতির আকার বাড়ছে কিন্তু তাতে শেয়ারবাজারের অবদান ক্রমেই কমছে। এটা আশঙ্কাজনক। অন্যদিকে লেনদেনে শেয়ারবাজারের আচরণও প্রত্যাশিত নয়। এখানে সুবিধা করতে না পেরে বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজার ছাড়ছেন। তবে অল্প সময়ে এতো বেশি সংখ্যক বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজার ছেড়ে যাওয়া শুভ লক্ষণ নয়।
সেন্ট্রাল ডিপজিটরি বাংলাদেশ (সিডিবিএল) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা (বিও হিসাব) ছিল ২৭ লাখ ৬৪ হাজার ৩৮৭ জন। যা কমে ১ আগস্ট দাঁড়িয়েছে ২৬ লাখ ১৩ হাজার ১৩৪ জনে। অর্থাৎ বিও হিসাব বন্ধ করে একমাসে শেয়ারবাজার ছেড়ে চলে গেছেন ১ লাখ ৫১ হাজার ২৫৩ জন বিনিয়োগকারী। ছেড়ে যাওয়া এই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ১ লাখ ১১ হাজার ৬৩৫ জন পুরুষ এবং ৩৯ হাজার ২৭৬ জন নারী; বাকী ৩৪২টি কোম্পানির বিও হিসাব।
এখানে উল্লেখ্য যে, শেয়ার ব্যবসায়ের জন্য একজন ব্যাক্তি নিজ নামে শুধু একটিই বেনিফিশিয়ারি ওনার্স বা (বিও) বিও হিসাব খুলতে পারেন। তাই একটি বিও হিসাবের বিপরীতে একজন বিনিয়োগকারী ধরা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে দেশের শেয়ারবাজার স্থবির হয়ে আছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শেয়ারবাজার তেমন ভূমিকা রাখতে পারছে না। সংস্কারমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপের পরও বাজার পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি নেই। ভালো মানের নতুন শেয়ারও বাজারে আসছে না। এতে শেয়ারবাজারের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য শেয়ারবাজারের বিকাশ অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করেন শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক এই চেয়ারম্যান।
সিডিবিএল’র তথ্যমতে, শেয়ারবাজার ছেড়ে যাওয়া বিনিয়োগকারীদের মধ্যে স্থানীয় বা আবাসিক বিনিয়োগকারী ১ লাখ ৪১ হাজার ৫৭৫ জন এবং প্রবাসী বা অনাবাসিক বিনিয়োগকারী ৯ হাজার ৩৩৬ জন। এর মধ্যে আবার একক বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ৯২ হাজার ৮০৪টি জন এবং যৌথ বিনিয়োগকারী ৫৮ হাজার ১৩৭ জন।
সিডিবিএল’র কর্মকর্তারা জানান, নির্ধারিত সময়ে নবায়ন না করায় এবং বিনিয়োগকারীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে বিও হিসাবগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এটা চলমান প্রক্রিয়া।
এর আগে ২০১৬-১৭ এর তুলনায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুনে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ১ লাখ ৬৪ হাজার ২৫২ জন কমে দাঁড়ায় ২৭ লাখ ৬৪ হাজার ৩৮৭ জনে। ওই সময় পুরুষ বিনিয়োগকারী কমে ১ লাখ ১১ হাজার ৭৩৪ জন এবং নারী বিনিয়োগকারী কমে ৫৩ হাজার ২২২ জন। আর ২০১৫ সালের জুনের পর থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত তিন বছরে ৪ লাখ ৩১ হাজার ১৬৩ জন বিনিয়োগকারী তাদের বিও হিসাব বন্ধ করে শেয়ারবাজার ছেড়ে চলে গেছেন। যার মধ্যে ৩ লাখ ৭ হাজার ২১৫ জন পুরুষ এবং ১ লাখ ২৫ হাজার ৬২৬ জন নারী বিনিয়োগকারী।
অর্থনীতিবিদ ও শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ধসের পর থেকে শেয়ারবাজার মন্দাবস্থায় রয়ে গেছে। লোকসানে থাকা পোর্টফোলিও অচল হয়ে আছে। লাভের আশায় যারা বিনিয়োগ করেছেন, ঋণ নিয়ে শেয়ার কিনেছেন তারা কোনো আশা দেখছেন না। বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার মতো ভালো কোম্পানিও আসছে না। এ অবস্থায় বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে তারা চলে যাচ্ছেন। শেয়ারবাজার চাঙ্গা করতে হলে ভালো কোম্পানি আনার পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের পলিসি সাপোর্ট দেওয়া দরকার বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এই অধ্যাপক।