খুলনা অঞ্চলে অর্থ সংকটে রাষ্ট্রায়ত্ত ৯ পাটকল
মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার: শ্রমিক কর্মচারীদের ৩১ কোটি টাকা মজুরি ও বেতন বকেয়া খুলনা-যশোর অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯ পাটকলে। উৎপাদিত প্রায় ৩০০ কোটি টাকার পাটজাত পণ্য পড়ে আছে। এ অবস্থায় মিলগুলোও পড়েছে অর্থ সংকটে। ফলে প্রয়োজনীয় পাট কিনতে পারছে না মিলগুলো। আর বকেয়া মজুরি না পাওয়ায় শ্রমিকরা পড়েছে চরম বিপাকে। গত ঈদের পর থেকে এ পর্যন্ত শ্রমিকদের ৫-৬ সপ্তাহের মজুরি বকেয়া। সব মিলিয়ে ৯ পাটকলে শ্রমিকদের বকেয়া মজুরির পরিমাণ ২০ কোটি ৬০ লাখ টাকা। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ২-৪ মাসের বকেয়া বেতনের পরিমাণ ১০ কোটি ৮০ লাখ। গত ৬ মাস ধরে আন্তর্জাতিক ও লোকাল বাজারে পাটপণ্য বিক্রি না হওয়ায় খুলনা অঞ্চলের ৯ পাটকলে ৩০০ কোটি টাকার মজুদ পণ্য অবিক্রিত। পাট মৌসুম শুরু হলেও পাট ক্রয় করতে পারছে না মিলগুলো। পাট ক্রয়ে সরকার কোনও টাকা বরাদ্দ দেয়নি। পাট ব্যবসায়ীদের কাছে দেনা ২০৩ কোটি টাকা। ফলে পাট ব্যবসায়ীরাও বিপাকে পড়েছেন।
পাট ব্যবসায়ী নূরুল ইসলাম বাবুল আমাদের অর্থনীতিকে বলেন, ‘গত দু’বছর কোনও টাকা পাননি তারা। এর ফলে তারা নতুনভাবে পাট সরবরাহে সংকটে রয়েছেন। অর্থ বকেয়া রেখে পাট দিয়ে অর্ধশত পাট ব্যবসায়ী বিপাকে পড়েছেন।’
পাটকলে পড়ে থাকা পণ্যক্রিসেন্ট জুট মিলে শ্রমিকদের ৫টি মজুরির সোয়া ৬ কোটি টাকা এবং কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ২ মাসের বেতন বাবদ ১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা বকেয়া পড়েছে। মিলে পাট খাতে দেনার পরিমাণ প্রায় ৫৫ কোটি টাকা। অবিক্রিত পাট পণ্য মজুদ রয়েছে ৬৫ কোটি টাকা। প্রায় দেড় কোটি টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া। পাটের মজুদ আছে ২ সপ্তাহের। প্লাটিনাম জুট মিলে শ্রমিকদের ৫টি মজুরি বাবদ প্রায় ৫ কোটি এবং কর্মচারি ও কর্মকর্তাদের ২ মাসের বেতন বাবদ ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা বকেয়া। পাটখাতে দেনা ৪০ কোটি টাকা। উৎপাদিত পণ্য অবিক্রিত রয়েছে প্রায় ৬৫ কোটি টাকা। খালিশপুর জুট মিলে শ্রমিকদের ৪ সপ্তাহের মজুরি প্রায় ২ কোটি এবং কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা বকেয়া। পাট ব্যবসায়ীদের কাছে দেনা আছে প্রায় ২৫ কোটি টাকা। স্টার জুট মিলে শ্রমিকদের ৩ সপ্তাহের মজুরি বকেয়া। অর্থের পরিমাণ ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ২ মাসের বেতনের ১ কোটি ১০ লাখ টাকা বকেয়া। পাট খাতে দেনা প্রায় ২৮ কোটি টাকা। মজুদ পাট পণ্য প্রায় ২১ কোটি টাকার। আলীম জুট মিল শ্রমিকদের ৬ সপ্তাহের মজুরির বকেয়া এক কোটি ৬ লাখ টাকা। কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের ৪ মাসের বেতনের প্রায় ৮৮ লাখ বকেয়া। পাটপণ্য অবিক্রিত প্রায় ১৫ কোটি টাকা। পাট ব্যবসায়ীদের কাছে দেনা প্রায় ১২ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ বিল বাবদ ২৪ লাখ টাকা বকেয়া। ইস্টার্ন জুট মিল শ্রমিকদের ৬ সপ্তাহের মজুরির বকেয়া ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। কর্মচারী কর্মকর্তাদের ৩ মাসের বেতন বাবদ ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। পাটখাতে দেনা প্রায় ১৭ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ খাতে দেনা ৩৫ লাখ টাকা। মিলে মজুদ পণ্য প্রায় ১৫ কোটি টাকার।
ক্রিসেন্ট জুট মিলের মহাব্যবস্থাপক গাজী শাহাদাত হোসেন জানান, মিলের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হলে শ্রমিকদের মজুরি প্রদান করাসহ দেনা পরিশোধ করা সম্ভব হত। তাছাড়া পাটের অভাবে মিলের অধিকাংশ লুম বন্ধ রয়েছে।
প্লাটিনাম জুট মিলের মহাব্যবস্থাপক মুজিবর রহমান মল্লিক জানান, একদিকে শ্রমিকদের মজুরির চাপ। ব্যবসায়ীদের পাওনার চাপ। পাট না থাকায় উৎপাদন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। মজুদ পাট পণ্য বিক্রি হলে এ সমস্যা থেকে কিছুটা পরিত্রাণ পাওয়া যেত।
খালিশপুর মিলের প্রকল্প প্রধান ইঞ্জিনিয়ার শফিকুল ইসলাম জানান, তার প্রধান সমস্যা শ্রমিকদের বকেয়া ও পাট ব্যবসায়ীদের দেনা। এ মিলে পাটের কভারেজ ৫০ দিন। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হলে তার মিলের সমস্যা অনেকটা কেটে যাবে।
স্টার জুট মিলের প্রকল্প প্রধান এফ এম বলুর রশিদ জানান, শ্রমিকদের মজুরি প্রদান করে মিলের কাজ সচল রাখার প্রচেষ্টা চলছে। এ মিলে ২০ দিনের পাট মজুদ আছে।
ইস্টার্ন জুট মিলের প্রকল্প প্রধান ড. জুলফিকার আলী জানান, শ্রমিক, কর্মচারী ও পাট ব্যবসায়ীদের দেনার প্রচ- চাপ রয়েছে।
জেজেআই’র প্রকল্প প্রধান ইঞ্জিনিয়ার নূরুল ইসলাম জানান, মিলে ১০ দিনের পাট মজুদ আছে।
কার্পেটিং জুট মিলের মহাব্যবস্থাপক বনিজ উদ্দিন আহমেদ জানান, মিলে ৩ দিনের পাট আছে।
বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) খুলনা জোন প্রধান শেখ রহমত উল্লাহ জানান, মিলের বড় সমস্যা হচ্ছে উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত পাট মজুদ নেই। উৎপাদিত পাট পণ্য অবিক্রিত থাকায় অর্থ সংকট রয়েছে। শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তাদের মজুরি ও বেতন বকেয়া পড়েছে। এ অবস্থায় শ্রমিকরা শনিবার ৭ পাটকলে মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন ও বকেয়া মজুরির জন্য গেট সভা করেছে। এ সব সমস্যার কথা বিজেএমসিকে জানিয়েছেন। তারা এ বিষয় মন্ত্রণালয়ের সহযোগীতায় সমাধানের পথ খুজছেন বলে তিনি জানান।
ক্রিসেন্ট জুট মিলের তাঁত বিভাগের শ্রমিক মহিদুল জানান, পাটের অভাবে মিলের বেশিরভাগ তাঁত বন্ধ থাকায় তাকে ৮ ঘণ্টার বিপরীতে মাত্র ৪ ঘণ্টার কাজ দিচ্ছে। তার ৬ সপ্তাহের মজুরি বকেয়া। ফলে পরিবার পরিজন নিয়ে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে।
প্লাটিনাম জুটমিলের শ্রমিক হাসান শেখ জানান, গত কয়েকদিনে তরকারির দোকানদারও বাকিতে পণ্য দিচ্ছে না। লবণ দিয়ে তিন বেলার স্থলে ২ বেলা আধপেটা খেয়ে দিনযাপন করছেন।
স্টার জুটমিলের শ্রমিক বেল্লাল হোসেন জানান, তাদের আর কোনও দোকানদার বাকিতেও চাল ডাল দিচ্ছেন না। ফলে সংসার চলছে যেনতেনভাবে। নিয়মিত মজুরি না দিলে তাদের বাঁচার উপায় নেই।
ক্রিসেন্ট জুট মিল সিবিএর সাধারণ সম্পাদক সোহরাব হোসেন জানান, পাটকলের শ্রমিকদের প্রধান সমস্যা বকেয়া মজুরি ও মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন করা। অবিলম্বে পাট ক্রয়ের জন্য অর্থ ছাড় দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। আর এসব সমস্যা নিয়ে বিজেএমসির সঙ্গে বহুবার বৈঠক হলেও সমাধান হয়নি।