বাংলাদেশের ফুটবল, আরেকবার স্বপ্ন দেখা কি পাপ?
মেজর ডা. খোশরোজ সামাদ : ১. ক্রোয়েশিয়া, এই তো ১৯৯৩ সালে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ১১৬ তম স্থানে ছিল সদ্য স্বাধীন দেশ। অথচ স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার প্রায় দুইযুগ পেরুনো বাংলাদেশ নামের জনপদের ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে অবস্থান ১১৯, সেই ক্রোয়েশিয়ার নিচে। এটি আমাদের ফুটবলের জন্য লজ্জা পাবার জন্য যথেষ্ট ছিল। তাই আশাবাদ, এই লজ্জা কাটিয়ে নূন্যতম একটি অবস্থান বাংলাদেশ ফুটবলের নিরন্তর চেষ্টা থাকবে। হায় ! স্বাধীনতার সিলভার জুবিলী বছরে সেই ক্রোয়েশিয়া বিশ্বকাপ ফুটবলের রানার্স আপ হল, আর বাংলাদেশের ফিফা র্যাঙ্কিং হিমাঙ্কের নীচে নামতে নামতে মাপন যন্ত্রে শেষ দাগকেও ছাড়িয়ে গেল!
২. বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের নৈরাশ্য কি শুধুই ফুটবলের? আশা জাগানিয়া উত্তর ‘না’। সিক্স এন্ড নাইন সিক্সটি নাইনের মত এই ফুটবলের কাউন্টার পার্ট নারীদলের সাফল্য নেহাতই কম নয়। হংকং-এ বিগত এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত জকি কাপে একটি ম্যাচও না হেরে চ্যাম্পিয়ন হয়ে শিরোপা ছিনিয়ে এনেছিল অনুর্ধ্ব-১৫ নারী ফুটবল দল। তার অল্প ক’দিন আগে বঙ্গমাতা গোল্ড কাপে কলসুন্দর স্কুলের মেয়েরা প্রত্যাশা পরিধির চেয়ে প্রাপ্তির ঝুড়িকে বড় করে ফেললো। পরপর তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে এক ‘মিথের’ জন্ম দিল তারা।
৩. শুধু কি নারী ফুটবল। মাত্র দুইযুগ আগে বাংলাদেশ ক্রিকেটের কি হাল ছিল? ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া দূরে থাক জিম্বাবুয়েকেও হারানো শুধু স্বপ্নেই সম্ভব ছিল। প্রতিবেশী দুইদেশ ভারত বা পাকিস্থানের কোন খেলোয়াড়ের মধ্যে নিজের ফেভারিট খেলোয়াড়ের প্রতিবিম্ব দেখে সান্ত¡না পেতে হত। আজ বাংলাদেশের ক্রিকেট টিম বিশ্বের সকল ক্রিকেট খেলুড়ে টিমকে অন্তত একবার করে হারানোর স্বাদ পেয়েছে। সেই বিবেচনায় ক্রিকেটে বাংলাদেশ বিশ্বকে জয় করেছে বললে অত্যুক্তি হবে না।
৪. ক্রোয়েশিয়ার রানার্সআপ হবার পিছনের মূল রহস্য আমাদের পুরোপুরি জানা না থাকলেও অনেক গুলি ধাপের কথা ফুটবলমোদী হিসেবে সাধারণ যুক্তিবুদ্ধিতে যোগবিয়োগ করে বলা যেতে পারে। স্বল্প মেয়াদী, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছিল এই দেশের। মাত্র তিনদশক আগে ক্রোয়েশিয়া স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীন দেশে ‘ট্যালেন্ট হান্ট’ করে সারা দেশে চিরুনি অভিযান চালিয়ে শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ই শুধু নয়, সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়দের তারা খুঁজে বের করেছিল। এই বাছাই পর্বটি যে পুরোপুরি পেশাদারি মনোভাব নিয়ে করা হয়েছিল সেটি নিশ্চিত। অযোগ্য কোন খেলোয়াড় মামা-চাচা বা ক্ষমতাধর ব্যক্তির সুপারিশে যে সুযোগ পায়নি সেটি নিয়ে কোন ভিন্নমত নেই। এই নির্বাচনের মূল চালিকাশক্তি কঠিন দেশপ্রেমের জারক রসে যে জারিত সেটাও নিশ্চিত করে বলা যায়। আসে ভাল কোচের প্রশ্ন। মেধাবী, অভিজ্ঞ পরিশ্রমী কোচ যে তাদের ছিল সেটিও নিশ্চিত। আসে অর্থ সংকুলানের প্রশ্ন। ইউরোপের ব্রিটেন, ইতালী, স্পেন বা ফ্রান্সসহ অন্যান্য দেশে ফুটবলে বিভিন্ন লীগে মিলিয়ন মিলিয়ন ইউরো খরচের যে মহোৎসব হয় তার তুলনায় ইউরোপের প্রায় রুগ্ন দেশ ক্রোয়েশিয়ার লগ্নি যে নস্যি সেটি বুঝতে অর্থনীতিবিদ হতে হয় না। ক্রোয়েশিয়া তার সম্পদের এই সীমাবদ্ধতাকে পরিকল্পিত, সুষম বণ্টন, সময়োপযোগী ব্যবস্থাপনা, বুকে-পিঠে পাথর লাগিয়ে অতিক্রম করেছে। দলের কঠোর অনুশীলন, প্রতিশ্রুতিশীল খেলোয়াড়দেরকে বিকশিত খেলোয়াড়ে পূর্ণতা দান, কোন ক্ষমতাধরের ব্যক্তিগত বিরাগভাজন হলে তাকে সাইড টিমে বসিয়ে না রাখা এই উপাদানগুলি আন্ডার ডগ ক্রোয়েশিয়াকে সারা দুনিয়ার ফুটবলমোদীদের ভালবাসায় সিক্ত করেছে। কাউকে ‘মেসি’র মত সুপারডুপার তারকা বানাতে যেয়ে দলের টিম স্পিরিটকে নষ্ট করে ‘টোটাল ফুটবলের’ বারোটা বাজানো হয় নি। খেলোয়াড়দের পারস্পরিক ভালোবাসা-শ্রদ্ধার সম্পর্ক যে প্রশ্নাতীত ছিল সেটিও দিব্যি বোঝা যায়। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্তরের ব্যক্তির স্নেহ এবং অনুরাগের প্রমাণ বিশ্বের কোটি দর্শক টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছে।
৫. আশির দশকেও ঢাকার স্টেডিয়াম ব্রাদার্স ইউনিয়ন, ওয়ান্ডারার্স, জাতীয় মধ্যম সারির দল ছাড়াও আবাহনী-মোহামেডানের মত বিপুল শক্তিশালী দল দাপিয়ে বেড়িয়েছে। এই দুইদলের খেলার দিন শুধু স্টেডিয়ামেই নয় সারা দেশেই উৎসবের আনন্দ লেগে থাকতো। সালাউদ্দিন, আসলাম, চুন্নু, মুন্না, কায়সার হামিদের মত খেলোয়াড়েরা ঢাকা স্টেডিয়ামে খাপখোলা তরবারির মত ঝলসে উঠত। তারপর নব্বই দশক থেকে পতনের যে ধারা একটু একটু করে শুরু হয় সেটি ক্যান্সার কোষের মত বাংলাদেশের ফুটবলকে প্রায় গিলেই ফেলেছে।
৭. ফুটবল সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয় হলেও ওয়ার্ল্ড কাপে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ চিন, ভারত, পাকিস্থান, ইন্দোনেশিয়ার সাফল্য সামান্যই। কাপটি ব্যাখ্যা প্রায় অতীত কারণে দক্ষিন আমেরিকার দরিদ্র কিছু দেশ যেমন ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে অথবা চিনের জনসংখ্যার দশভাগের এক ভাগের কিছু ইউরোপীয় দেশ যেমন ফ্রান্স, জার্মান, ইতালী বা ইংল্যান্ডের ঘরেই যাচ্ছে বারবার। তাই, বিশ্বকাপ ছিনিয়ে আনবে এমন এই অলীক আশাবাদ করা আর ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে কোটি টাকার মালিক হবার স্বপ্ন একই হবে। তবে প্রথমে দেশের মাটিতে ফুটবল বিমুখ দর্শকদের কাছে অন্ত আস্থা আর সম্মানের যায়গাটা ফিরিয়ে আনা জরুরি। আশির দশকে ঢাকা স্টেডিয়ামে যে প্রাণচাঞ্চল্যের জোয়ার বয়ে যেত আপাতত সেটুকু ফিরিয়ে আনতে পারলেই বাংলাদেশের কোটি ফুটবল অনুরাগী খুশীর জোয়ারে ভাসবে। মানুষ বাঁচে আশায়, মানুষ বাঁচে স্বপ্নে। বাংলাদেশের ফুটবলে হারিয়ে যাওয়া গৌরবময় দিন ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখা কি পাপ? লেখক: উপ অধিনায়ক, আর্মড ফোর্সেস ফুড এন্ড ড্রাগস ল্যাবরটরী