কোমলমতিদের আন্দোলনে বিদেশি সমর্থন
মাসুদা ভাট্টি : আপাতত: আন্দোলনের একটা সমাপ্তি ঘটেছে। সরকার শিশু-কিশোরদের ৯-দফা দাবির কতোটা কি পূরণ করতে যাচ্ছে তাও স্পষ্ট। হতে পারে সেগুলোতে অনেকেরই আপত্তি থাকবে এবং থাকারই কথা কিন্তু তারপরও ছাত্র-ছাত্রীদের এই আন্দোলনকে বাংলাদেশে গত এক দশকে হওয়া সকল আন্দোলনের মধ্যে সফলতম বলে উল্লেখ করা অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ‘বড়রা’ বাংলাদেশকে দেশে ও বিদেশে কোন্্ ও কী মাত্রা দিয়েছে তা নিয়ে এই মুহূর্তে আলোচনা না হলেও নিকট ভবিষ্যতে তা নিয়ে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। তবে এই মুহূর্তে এই আন্দোলন চলাকালে বিদেশিদের তৎপরতা বিষয়ে আলোচনাটা হওয়া আবশ্যক।
এ পর্যন্ত যে ক’টি দূতাবাসের পক্ষ থেকে বিগত সপ্তাহ ধরে চলা শিশু-কিশোরদের নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন ও এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়া সংঘাত, সহিংসতা বিষয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করেছে তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয় ইউনিয়ন অন্যতম। এর বাইরে জাতিসংঘ বাংলাদেশ দফতরের পক্ষ থেকেও একটি বিবৃতি দেওয়া হয়েছে গণমাধ্যমে। প্রত্যেকেই এই আন্দোলনকে যৌক্তিক বলে দাবি করে একে ঘিরে ঘটা সহিংসতার নিন্দা করেছে এবং অবিলম্বে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এই বিবৃতিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন ব্যাপারে নাক গলানো হিসেবে দেখছেন। যদিও বিবৃতিগুলিতে এই আন্দোলনকে যৌক্তিক বলা হয়েছে এবং যা সরকারও মনে করে বলে প্রধানমন্ত্রী থেকে সকলেই স্বীকার করেছেন। কিন্তু যে সহিংসতার কথা বিদেশি দূতাবাস বা জাতিসংঘের পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়েছে তার জন্য মূলতঃ সরকারের পুলিশ ও হেলমেটধারী আক্রমণকারীদেরকেই দায়ী করা হয়েছে। যদিও প্রথম দিন পুলিশ স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীদের ওপর কোথাও কোথাও চড়াও হলেও তারপর থেকে কোনো শিশুর ওপর পুলিশি হামলার কথা জানা যায় না। গণমাধ্যমকে এক প্রকার শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন গুজব রটনাকারী পক্ষ সরকার, পুলিশ ও সরকারি দলের পেটোয়া বাহিনীর হাতে যে শিশু-কিশোরদের আক্রমণ করা হচ্ছে তাই-ই প্রচার করা হয়। বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, বিদেশি দূতাবাস ও জাতিসংঘ সেসব আমলে নিয়েছে এই বিবৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে। কিন্তু তারপরও তারা সরকারের কাছেই আবেদন জানিয়েছে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য। মজার ব্যাপার হলো, খোদ্্ আমেরিকার বিখ্যাত শহর শিকাগোতে গত কয়েকদিনের রাজনৈতিক সহিংসতায় ১১ জন মারা গেলেও কোনো বিদেশি দূতাবাস বা জাতিসংঘের পক্ষ থেকে কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায় না। প্রশ্ন থেকেই যায় যে, বাংলাদেশকে কেন বার বার বিদেশিদের এরকম নসিহত পেতে হয়?
এরকম প্রশ্নের উত্তরে এটা প্রমাণিতই হয় যে, বার বার বিদেশিদের কাছে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলি ধর্না দেয় যখন বিরোধী দলে থাকে। এটা আওয়ামী লীগ যেমন করে তেমনই বিএনপি-জামায়াতও করে থাকে। এমনকি দেশের বামপন্থী দলগুলো, একদা যারা বিদেশি হস্তক্ষেপকে কবীরা গুণাহ্ বলে মনে করতো তারাও আজকাল বিদেশিদের কাছে ধর্না দিয়ে দেশের অভ্যন্তরীন সমস্যা সমাধান করতে চায়। সদ্য শেষ হওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনও যখন শিশু-কিশোরদের হাত থেকে ছুটে গিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করা দলগুলোর হাতে চলে যাচ্ছিলো এবং তাতে এদেশের বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই সামিল হয়ে মিথ্যাচার ও গুজবকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে মূলধারার সংবাদ মাধ্যমের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করে তখন সরকারও যে কঠোর হওয়ার ঘোষণা দেয় তাতে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। তারপরও যুক্তিবাদী মানুষ একথা মনে করে যে, সরকার সফলভাবে এই আন্দোলনকে থামাতে পেরেছে এবং কোমলমতি শিশুদের ঘরে বা স্কুলে ফিরিয়ে দিয়ে বিদেশি দূতাবাস বা জাতিসংঘের দাবি মোতাবেক সংঘাত বন্ধ করতে সফল হয়েছে। এখন নতুন করে যেসব পক্ষ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গন্ডোগোল সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে তাদের ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর হওয়াকে কেউ আর অযৌক্তিক মনে করছে না।
প্রশ্ন হলো, এরই মাঝে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত গভীর রাতে কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে যখন কোনো রাজনৈতিক নৈশভোজে মিলিত হন তখন তার গাড়িতে হামলার অভিযোগ এই আন্দোলনকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি মাত্রা দেয়। সেটি আর কিছুই নয় যে, এরকম একটি ডামাডোলে বা মার্কিন দূতাবাস কর্তৃক কথিত সহিংসতার মাঝে রাষ্ট্রদূত কোনো প্রকার নিরাপত্তা-সুরক্ষা ছাড়াই কী করে এরকম একটি নৈশভোজে যোগ দেন? এই নৈশভোজের গুরুত্ব কি মার্কিন রাষ্ট্রদূতের প্রাণের চেয়েও বেশি? এমনিকে মার্কিন কর্তৃপক্ষ সে দেশের নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণে বিভিন্ন সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছে এবং বিশেষ করে এই আন্দোলন চলাকালে সকলকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তবেই চলাচলের জন্য আবেদন করার পরও মার্কিন রাষ্ট্রদূত এভাবে গোপন নৈশভোজে কী করে যান সে বিষয়টি মাথায় রেখেই হয়তো এই হামলার অভিযোগটি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা কোথাও শোনা যাচ্ছে না। এমনকি কোনো বিদেশি গণমাধ্যমেও এই খবরটি প্রকাশিত হয়েছে কিনা তা জানা যায় না। যদিও আমরা জানি যে, মধ্যপ্রাচ্য বা অন্য যে কোনো দেশে মার্কিন দূতাবাসের কোনো সাধারণ কর্মচারী/কর্মকর্তাও যদি হামলার শিকার হন তাহলে সেটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর হয়। কেন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের গাড়িতে হামলার পরও এ বিষয়টি নিয়ে আর কোনো দেশ না হোক খোদ্্ যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমেই কোনো আলোচনা নেই সে প্রশ্নের উত্তরের মাঝেই হয়তো নিহিত রয়েছে সদ্য শেষ হওয়া কোমলমতি আন্দোলনের নেপথ্যে অ-কোমলমতিদের উদ্দেশ্যটি। নিশ্চয়ই এ বিষয়ে সকল পক্ষ আরো বিস্তারিত আলোচনা করবেন, এবং অতি দ্রুত আমরা এ বিষয়ে আরো জানতে পারবো।