জন্মদিন যখন রাজনীতির নির্ধারক
মাসুদা ভাট্টি : ষাট-সত্তর-আশির দশকেও বাংলা চলচ্চিত্রের একটি জনপ্রিয় গল্প ছিল এরকমÑ প্রথম সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মায়ের মৃত্যু হয়েছে। বাবা স্ত্রীর প্রতি প্রেমবশত সন্তানকে চোখের দেখা দেখতেও পারেন না, এমনকি বড় হওয়ার পরও সন্তানকে তিনি গ্রহণ করতেও রাজি নন। অনেক টানাপড়েন শেষে বাবা আর সন্তানের মিল হয় এবং সিনেমার একটি হাততালি-সমাপ্তি ঘটে। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের রাজনীতি সিনেমা নয়, তবে সিনেমাকেও হার মানায়। সিনেমা নয়, কারণ এদেশের রাজনীতি একেবারেই সাদাকালো, রঙিন কোনো কিছুই এই রাজনীতিতে নেই। দেশের মানুষ ক্রমাগত এই সত্য তাদের জীবন দিয়েই বুঝতে পারে। আর সিনেমাকে হার মানায় কারণ আমরা দেখতে পাই যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট তারিখে যেদিন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, সেই দিনটি থেকে বাংলাদেশের জন্ম-ইতিহাস, চরিত্র ও গতিপথ বদলাতে শুরু করে। শুরু হয় নতুন ও ভয়ঙ্কর এক আখ্যান। সে আখ্যানে আমরা দেখতে পাই যে, নতুন নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়, যারা মূলত বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী-বিরোধিতাকেই তাদের মূল উপজীব্য করে তোলে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উন্নয়ন কিংবা এদেশের জনগণের ভাগ্যোন্নয়ন নয়, কেবলমাত্র একটি পঁচা-গলা ও পরিত্যক্ত রাজনৈতিক দর্শনের চর্চা এবং তার মূল কাঠামোয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের চরিত্র হরণসহ মুক্তিযুদ্ধকে দূরে ঠেলে রেখে দেশকে একটি লুঠপাটের বাজার করে তোলাই হয়ে ওঠে লক্ষ্য। কিন্তু এসব সবই মেনে নেওয়া যায়, যদি জনগণ এসব জেনেও এই রাজনীতিকে গ্রহণ করে। যদিও জনগণ হিটলারকেও গ্রহণ করেছিল এবং তার নেতৃত্বে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও অংশ নিয়েছে জনগণই, তার মানে জনগণ যে সব সময় সঠিক কাজটি করে তা নয়।
কিন্তু ১৯৯০ সালে যখন বাংলাদেশ নতুন পথে হাঁটা শুরু করলো বলে দাবি করা হলো তখন আমরা দেখতে পেলাম যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পরে যে ধারায় বাংলাদেশের রাজনীতি হাঁটতে শুরু করেছিল তা থেকে রাজনীতি আসলে মুক্ত হয়নি। বিশেষ করে জেনারেল জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়াই কেবল নয় বাংলাদেশের রাজনীতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-বিরোধী পথে নিয়ে আসতে সফল হয়েছিলেন। কিন্তু তার স্ত্রী যখন ক্ষমতা পেলেন তিনি হাঁটতে শুরু করলেন আরো একটি নতুন পথে। সে পথ জিয়াউর রহমানের চেয়েও ভয়ঙ্কর। জিয়াউর রহমান যদি বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বেনিফিসিয়ারি হন তাহলে বেগম জিয়া কেবল খুনিদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়াই নয়, তিনি বঙ্গবন্ধুকেই মনে করলেন তার রাজনীতির মূল শত্রু। তিনি ১৫ই আগস্টকে তার জন্মদিন হিসেবে পালন করতে শুরু করলেন। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ যেদিন শোক পালন করে, যেদিন বঙ্গবন্ধুর দুই জীবিত কন্যারা পিতা-মাতা-ভাই-আত্মীয়কে নৃশংসভাবে হত্যার দিনটি চোখের জল আর তীব্র বেদনা নিয়ে পার করেন তখন কয়েক মণ ওজনের কেক কেটে বেগম জিয়া তার জন্মদিন উদযাপন শুরু করলেন। বিষয়টি এতটাই দৃষ্টিকটূ এবং নিষ্ঠুর যে, এ বিষয়ে কথা বলারও কিছু থাকলো না এদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষক বা বুদ্ধিজীবীদের। যদিও কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী বেগম জিয়াকে এ জন্য প্রশংসাও করেছেন বলে শোনা যায়। ফলে দু’পক্ষের রাজনীতির বিভাজন রেখাটি প্রশস্ত থেকে প্রশস্ততর হতে শুরু করলো এবং ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলার পর তা এখন সমুদ্রসম দূরত্বের জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দূরত্ব ঘুচিয়ে কেউ যদি ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের’ আশা করেন এবং ভাবেন যে, রাজনীতিতে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দায় ও দায়িত্ব কেবল বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার তাহলে এই চাওয়াটা অত্যন্ত কদর্য হয়ে ওঠে।
দেশের রাজনীতিতে জল বহুদূর গড়িয়েছে। এই মুহূর্তে দুই পক্ষই যুযুধান ও আক্রমণাত্মক অবস্থায় রয়েছে। দুর্নীতির দায়ে বেগম জিয়া কারাগারে আছেন। জিয়াউর রহমানও নৃশংস হত্যাকা-ের শিকার হয়ে মৃত। তার এক পুত্রের জীবনাবসান হয়েছে। আরেক পুত্র দুর্নীতির শাস্তি মাথায় নিয়ে পলাতক হয়ে লন্ডনে অবস্থান করছেন। এমতাবস্থায় দলটির ভেতর সুষ্ঠু রাজনীতির পরিবেশ তৈরির জন্য হলেও বেগম জিয়ার ‘বানোয়াট জন্মদিন’ উদ্্যাপন বন্ধ করার কথা ছিল। কিন্তু গণমাধ্যম থেকেই জানা গেছে যে, এবারও ঘটা করে না হলেও জন্মদিন উদ্্যাপন হচ্ছে বেগম জিয়ার এবং সেটা দলীয় ভাবেই। এরপরও রাজনীতিতে আমরা ‘লেভেল প্লেইং ফিল্ড’ চাইছি, যখন একটি মিথ্যা জন্মদিনকেও আমরা রাজনীতির হাতিয়ার করা থেকে বাদ দিতে পারছি না।
লেখক: সিনিয়র নির্বাহী সম্পাদক, আমাদের অর্থনীতি